‘দুর্নীতিবাজদের জন্য দুদক হবে আতঙ্কের নাম’- এই বক্তব্য সামনে রেখে সাবেক সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাসের মধ্যে প্রায় দুইশ’ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। অনেকে গ্রেফতার আতঙ্কে আত্মগোপনে আছেন। কেউ কেউ গোপনে দেশত্যাগ করেছেন বলেও জানা গেছে।
বিগত কমিশনের সময়ে ওপরমহলের চাপ, তদবির, দুদকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অবহেলা, উদাসীনতা ও অসৎ মনোভাবের কারণে কমিশনের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে বর্তমান কমিশন।
দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল বলেন, দুদকের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা ও আস্থাহীনতার সংকট কাটিয়ে উঠতে যা যা করা দরকার, এই কমিশন তা করবে। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তিনি যত বড় প্রভাবশালীই হোন না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। দুদক চলবে তার আইন অনুযায়ী।
দুদক সূত্র জানায়, আলোচিত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের ৫৬ মামলা তদন্তে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তা যথাযথভাবে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করার জন্য এরই মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্তে তার বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেলে চার্জশিটে তাকে আসামি করা হবে। এর আগের কমিশনের সময়ে দায়ের করা ওই ৫৬ মামলার একটিতেও বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ঋণের নামে ব্যাংকটির সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাটের পুরো সময়ে বাচ্চু ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। এই অর্থ আত্মসাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন, বেসিক ব্যাংক থেকে জব্দ করা কাগজপত্র দুদকের হাতে থাকলেও বিগত কমিশন বাচ্চুকে আসামি করেনি। এতে ওই সময় দুদকের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হয়। সেই ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতেই বর্তমান কমিশন নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের নেতৃত্বে বিগত কমিশনের সময় ২০১২ সালে হলমার্ক, ডেসটিনি, রেলে নিয়োগ দুর্নীতির মতো বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগে অনেককে আইনের আওতায় আনার ফলে সারাদেশে দুদকের ভামমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছিল। পরে মো. বদিউজ্জানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময় এসব অভিযুক্তকে একের পর এক দায়মুক্তির সনদ দিয়ে দুর্নীতিবিরোধী এই প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করা হয়েছে। এই সময়ে আস্থাহীনতার সংকটে পড়ে দুদক, যা উদ্ধারের চেষ্টা করছে বর্তমান কমিশন।
জনতা ব্যাংক
লিটু ফেব্রিক্সসহ সাত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। ঋণের নামে জালিয়াতি করে ওই পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্ত অন্য ৬ কোম্পানি হলো- ইব্রাহীম কটন, বিআরবি স্পিনিং, চৌধুরী টাওয়েলস, গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িং, রাঙ্গা সোহেল ও রাঙ্গা ডেনিম লিমিটেড। দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলমের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম গত বৃহস্পতিবার থেকে অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে।
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক বদিউর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় গত বৃহস্পতিবার। তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে সিঙ্গাপুরে তার মালিকানাধীন মেসার্স অ্যারিয়েল ম্যারিটাইম নামের একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া গেছে।
আলোচিত আসলাম চৌধুরী
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে যোগাযোগকারী হিসেবে অভিযুক্ত বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু হয়। রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপের অভিযোগে বর্তমানে তিনি কারাগারে।
মুন গ্রুপের চেয়ারম্যান
ভুয়া কোম্পানি গঠন করে ভুয়া জামানতের কাগজপত্র জমা দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক মতিঝিল প্রধান শাখা থেকে ২৭০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে মুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে। রাজধানীর কল্যাণপুরে সরকারি খাস জমির ভুয়া কাগজপত্র তৈরির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। একটি অস্ত্র মামলায় মিজানুর রহমান বর্তমানে কারাগারে।
আলোচিত শেয়ার ব্যবসায়ী
শেয়ার ব্যবসায় কারসাজি করে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে আলোচিত শেয়ার ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বাদলের বিরুদ্ধে। ২৫-৩০টি কোম্পানির শেয়ারে নিজ নামে কয়েকশ’ কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য পেয়েছে দুদক। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিনিয়োগ করেছেন বলে দুদকে পেশ করা অভিযোগে বলা হয়।
রূপালী ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ
ইনডেক্স পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি লিমিটেডসহ ৯ কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলে ঋণের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। অভিযুক্ত অন্য আট কোম্পানি হলো- তুরাগ এগ্রিটেক্স, গাজীপুর পেপার বোর্ড, শফিক স্টিল, মাফিয়া শিপ ব্রেকার্স, ক্রিস্টাল শিপ ব্রেকার্স, নাসিব এন্টারপ্রাইজ, জেনারেটর হাউস ও এসআরএস শিপ ব্রেকার্স।