প্রায় ১০০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো বাতাস ও প্রবল বৃষ্টি ঝরিয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ড অতিক্রম করে গেছে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সময় নিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল অতিক্রম করার সময় ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় জেলাগুলোর বেড়িবাঁধ ভেঙে বাড়িঘর, মাছের ঘের ও রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকার নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হয়।
ঘূর্ণিঝড়টি স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়ে আজ শনিবার রাত আটটা নাগাদ দেশের পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামের দিকে চলে যায়। সাগর শান্ত রয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড়টির সঙ্গে আসা মেঘের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আগামীকালও মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। ঝোড়ো হাওয়া ও ভারী বর্ষণের আশঙ্কায় চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর এবং কক্সবাজারকে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, রোয়ানু ছিল একটি ছোট সাইক্লোন। বাতাসের গতি বেশি থাকলে এর প্রভাবে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মাহমুদুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, প্রবল বৃষ্টি ঝরায় ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে এর কারণে যতটা ক্ষতি হতে পারত, ততটা হয়নি।
চট্টগ্রাম ও বরিশাল উপকূলে আঘাত হানে ‘রোয়ানু’
আজ বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম ও বরিশাল উপকূলে আঘাত হানে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ এটি স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, এটির বাতাসের গতিবেগ দেশের উপকূলের বিভিন্ন স্থানে ৬০ থেকে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে। এর ব্যাসের দৈর্ঘ্য ছিল ২০০ কিলোমিটার। তবে এর বাতাসের প্রান্তসীমা প্রায় ৭০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। ফলে দেশের প্রায় সব জেলাতেই ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টি বয়ে গেছে।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে বেশির ভাগ জেলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। গাছপালা উপড়ে ও পাহাড় ধসে গিয়ে অনেক এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বুলেটিন অনুযায়ী, রোয়ানু আজ সকাল নয়টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ১৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করে। একই সময়ে মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব, পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব ও কক্সবাজার থেকে ১৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এরপর এটি বরিশাল, বরগুনা উপকূল হয়ে চট্টগ্রামের দিকে আঘাত হানে।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার। দমকা অথবা ঝোড়ো বাতাসের আকারে এটি ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু কেড়ে নিল ২৩ প্রাণ
ঘূর্ণিঝড়টির আঘাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সাতজন, চট্টগ্রাম শহরে একজন, সীতাকুণ্ডে দুজন, কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় দুজন, নোয়াখালীর হাতিয়ায় তিনজন, ফেনী ও লক্ষ্মীপুরের একজন করে, ভোলায় তিনজন ও পটুয়াখালীতে একজন মারা গেছে।
চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, ঝড়ে উপকূলবর্তী উপজেলা বাঁশখালীতে সাতজন ও চট্টগ্রাম নগরে একজন নিহত হয়। দুটি ইউনিয়নের অন্তত চারটি ওয়ার্ড লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। সন্দ্বীপ উপজেলায়ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, উপকূলবর্তী খানখানাবাদ ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ উপচে জলোচ্ছ্বাসের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করলে পানিতে ভেসে দুই শিশুসহ ছয়জন মারা যায়। ছনুয়া ইউনিয়নে মারা যান আরও এক নারী। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় পানিতে ভেসে এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রামের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা বিদ্যুৎবিহীন
চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন আজ সন্ধ্যায় জানান, ঝড়ের কারণে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। পতেঙ্গায় বিদ্যুতের খুঁটি ও ট্রান্সফরমার পড়ে যায়। নগরের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা বিদ্যুৎবিহীন।
খেপুপাড়ায় হয়েছে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত
ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে আজ পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর পরিমাণ ছিল ২৫২ মিলিমিটার। এ ছাড়া পটুয়াখালীতে ১৯৬, বরিশালে ২৩০, ভোলায় ২০৯, মংলায় ১২৫, নোয়াখালীর মাইজদীকোর্ট এলাকায় ১৮১, ফেনীতে ১৪৬, মাদারীপুরে ১২৬, ও ঢাকায় ৬৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।