সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, পাকিস্তান বারবারই চরম ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। আর তুরস্ক যা করেছে তা পাগলামি, দেশটির রিসেপ তায়েপ এরদোগান পাগল হয়ে গেছেন। নিজের দেশে গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছেন, এখন বাইরের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও হস্তক্ষেপ শুরু করেছেন। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, পাকিস্তান ও তুরস্ক যা করেছে, তা এককথায় চরম বাড়াবাড়ি। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার আহ্বান সাবেক কূটনীতিকদের। তারা বলেন, কূটনীতিতে সবসময় আবেগের চেয়ে বুদ্ধি ও বিবেচনার প্রাধান্য থাকতে হয়। পাকিস্তান ও তুরস্কের আচরণে সুবিবেচনার পরিচয় পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের উচিত ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা।
সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখার পর থেকেই পাকিস্তান ও তুরস্ক নিজামীর পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চরম আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়া শুরু করে। নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তানের সংসদ নিজামীর প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণের ধৃষ্টতা দেখায়। গত ১১ মে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিও ছিল
চরম আপত্তিকর। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নাজমুল হুদাকে ডেকে পাঠায়। জবাবে ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলমকেও ডেকে তার দেশের অগ্রণযোগ্য আচরণের কঠোর প্রতিবাদ জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে নিজামীর মুত্যুণ্ডাদেশ কার্যকর করার পর তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ঘটনাকে ‘গভীর দুঃখের’ বলে বিবৃতি দেয় এবং মৃত্যুদণ্ড নিজামীর প্রাপ্য ছিল না বলে উল্লেখ করে। গতকাল বার্তা সংস্থা রয়টার্স তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপে এরদোগানকে উদৃব্দত করে জানায়, নিজামীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার প্রতিক্রিয়ায় তুরস্ক ঢাকা থেকে সে দেশের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। একই সময়ে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাডলু জানায়, নিজামীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ঢাকায় দায়িত্ব পালনরত সে দেশের রাষ্ট্রদূত ডেভরিক ওসতুর্ককে আঙ্কারায় ডেকে পাঠানো হয়েছে।
ঢাকায় তুরস্ক দূতাবাসের একটি সূত্র জানায়, তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে ঢাকা থেকে জরুরি ভিত্তিতে আঙ্কারায় ফেরত যেতে বলা হয়েছে। তাকে প্রত্যাহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো আদেশ গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আসেনি। এ অবস্থায় ঢাকায় দূতাবাসের কাজকর্মও স্বাভাবিকভাবে চলবে বলে জানায় ওই সূত্রটি। তবে তুরস্কের পদক্ষেপের বিষয়ে বাংলাদেশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক জানান, রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহারের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবহিত নয়। তুরস্কের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি। রাতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, তুরস্কের রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশের বাইরে যাচ্ছেন। তার অবর্তমানে কে দায়িত্ব পালন করবেন, সে কথাও জানিয়ে গেছেন। তিনি আরও বলেন, তুরস্ক যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে আগেও প্রশ্ন তুলেছে, তার জবাবও দিয়েছে বাংলাদেশ। তুরস্কের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটবে না বলেও মত দেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
পাকিস্তানকে কঠোর জবাব :গতকাল বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে ডেকে তার হাতে বাংলাদেশের কঠোর প্রতিবাদের লিখিত বার্তা তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, একাত্তরে গণহত্যা, গণধর্ষণ, লুটতরাজ ও অগি্নসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যাদের বিরুদ্ধে বিচার কাজ চলছে, পাকিস্তান অব্যাহতভাবে তাদের পক্ষ নিচ্ছে। ৪৫ বছর আগে সংঘটিত ভয়ঙ্কর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মধ্য দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য বাংলাদেশের জনগণের যে প্রচেষ্টা, পাকিস্তান তার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিচ্ছে। এটা পরিষ্কার একটি স্বাধীন দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ। পাকিস্তানের এ ধরনের কর্মকাণ্ড অগ্রহণযোগ্য ও শিষ্টাচারবহির্ভূত। বাংলাদেশ এর কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
বার্তায় পাকিস্তানকে আবারও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, নিজামী একাত্তর সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যার সহযোগী আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত বিচার প্রক্রিয়ায় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে, নিজামী বদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও লুটপাটের পরিকল্পনা করেছেন। একাধিক গণহত্যার ঘটনায় নিজেও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। অপরাধের স্পষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষেই আদালত তাকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছেন। পাকিস্তান নিজামীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে একাত্তরে গণহত্যার দায়-দায়িত্বও স্বীকার করে নিয়েছে।
বার্তায় আরও বলা হয়, ১৯৭৪ সালের চুক্তি সম্পর্কে পাকিস্তান নির্লজ্জ মিথ্যাচার করছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধে জড়িত ১৯৫ জন পাকিস্তানি নাগরিককে ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং তাদের বিচার পাকিস্তান সরকার করবে, এ শর্তে বাংলাদেশে তাদের বিচার না করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তান এখন পর্যন্ত সেই ১৯৫ জনের বিচার না করে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে। বাংলাদেশ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত বাংলাদেশি নাগরিকদের বিচার করছে, যার সঙ্গে ওই চুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই।
বাংলাদেশ আশা করে, পাকিস্তান ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও শিষ্টাচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবে এবং চরম আপত্তিকর বিবৃতি প্রত্যাহার করবে।
সাবেক কূটনীতিকদের অভিমত :সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, পাকিস্তান যে ধরনের বাড়াবাড়ি করছে, তার জবাব আরও কঠোর কূটনৈতিক ভাষায় দেওয়া উচিত। পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে রাত ১২টায় ডেকে পাঠানো এবং সর্বোচ্চ পরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দেওয়া উচিত। এটাই হবে পাকিস্তানের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের উপযুক্ত জবাব। তিনি আরও বলেন, তুরস্ক যেটা করেছে, সেটা একেবারেই অদ্ভুত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ অনেক যুদ্ধের সময়ও যুদ্ধরত দেশগুলো একে অপরের দেশ থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেনি। অথচ তুরস্ক কোনো কারণ ছাড়াই রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, পাকিস্তান এবং তুরস্ক যেটা করেছে, এককথায় চরম বাড়াবাড়ি। যাদের ফাঁসি হয়েছে, তারা তো পাকিস্তানের নাগরিক নয়। তাদের এত মাথাব্যথা কেন? এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া অর্থহীন। তিনি আরও বলেন, তুরস্কের আচরণ বিস্মিত করেছে। এটা খুবই অদ্ভুত। এটা কোনো ধরনের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই পড়ে না। তুরস্ক হাজার বছরের পুরনো সভ্য দেশ। তাদের কাছ থেকে এ ধরনের অপরিপকস্ফ সিদ্ধান্ত কোনোমতেই কাম্য নয়।