বাঁধভাঙা আনন্দ

Slider শিক্ষা
untitled-7_211684
দশ বছরের সাধনা শেষে মাধ্যমিকের চৌকাঠ পেরোল দেশের ১৪ লাখ ৫২ হাজার কিশোর-কিশোরী। বাঁধভাঙা আনন্দ এখন তাদের হৃদয়ে। ভালো ফলের আনন্দে উদ্বেলিত তারা। গতকাল বুধবার সারাদেশের স্কুল আঙিনাগুলো হয়ে উঠেছিল যেন উৎসবের হাট। শিক্ষার্থীদের সাফল্যের এ আনন্দ ছুঁয়ে গেছে তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকদেরও। সবাই মিলে নেচে-গেয়ে আনন্দে মেতেছেন। আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে গেছে লাখো শিক্ষার্থীর হৃদয়ে। পেয়েছে তারা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তির ছাড়পত্র। উত্তীর্ণদের চোখের তারায় খেলা করেছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন। গতকাল দুপুরে একযোগে আটটি সাধারণ বোর্ড এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি ও

সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। ফলের সব সূচকে সেরা না হলেও গতবারের চেয়ে এবার বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করেছে। সর্বোচ্চ জিপিএ ৫ প্রাপ্তির দিক থেকে গতবারের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে এবারের পরীক্ষার্থীরা। তবে ইংরেজি, গণিত, উচ্চতর গণিতসহ বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে সার্বিক ফলে মেধার স্বাক্ষর রেখেছে শিক্ষার্থীরা। এ বছর সারাদেশে মোট ১৬ লাখ ৪৫ হাজার ২০১ পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে পাস করেছে ১৪ লাখ ৫২ হাজার ৬০৫ জন। তাদের মধ্যে ৮ লাখ ৪১ হাজার ৪৭ ছাত্র ও ৮ লাখ ৪ হাজার ১৫৪ জন ছাত্রী। গড় পাসের হার ৮৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত বছর এ হার ছিল ৮৭ দশমিক শূন্য ৪ ভাগ। এবার পাসের হার এক দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়েছে। আর জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৭৬১ জন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৯০১ জন। সার্বিক বিচারে এবার ছেলেরা এগিয়ে। এ বছর থেকেই প্রথমবারের মতো এসএসসিতে বাতিল করা হয়েছে সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন। তাই সেরা প্রতিষ্ঠানের কোনো তালিকা এবার প্রকাশ করা হয়নি। মাধ্যমিকের এ ফলের দিক থেকে পাসের হারে গত কয়েকবারের মতো এবারও শীর্ষে রয়েছে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড। আর জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে ঢাকা বোর্ড এগিয়ে। পরীক্ষা শেষের ৫৭ দিন পর এবার ফল প্রকাশ করা হলো।

গতকাল দুপুর ১টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এর আগে সকাল ১০টায় শিক্ষামন্ত্রী সব শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফল তুলে দেন। প্রধানমন্ত্রী এবারের ফল নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘বছরের শুরুতেই বিনামূল্যে বই সরবরাহ করেছি, মেয়েদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছি, নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তবুও ছেলেমেয়েরা কেন ফেল করবে?’ তিনি বলেন, ‘এখন আগের মতো আর পরীক্ষার ফল পেতে শিক্ষার্থীদের ছোটাছুটি করতে হয় না, পয়সা খরচ করে স্কুলে গিয়ে ভিড় করতে হয় না। ঘরে বসেই ফল জানা যায়।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘বর্তমান সরকার শিক্ষার পরিবেশ সুনিশ্চিত করেছে বলেই পাসের হার বাড়ছে। সরকার শুধু লেখাপড়াই নিশ্চিত করছে না, বরং তাদের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করছে।’ তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান। সেইসঙ্গে শিক্ষক-অভিভাবকসহ সবাইকে তিনি অভিনন্দন জানান।

এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১০টি শিক্ষা বোর্ডে উত্তীর্ণ ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ৫৯৪ জনের মধ্যে ৭ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৭ ছাত্র ও ৭ লাখ ১০ হাজার ৮০৮ জন ছাত্রী। আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের এসএসসিতে পাসের হার ৮৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, আর মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৮৮ দশমিক ২২ ও কারিগরি বোর্ডে ৮৩ দশমিক ১১ শতাংশ। গত বছর আট বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮৬ দশমিক ৭২, মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৯০ দশমিক ২০ ও কারিগরি বোর্ডে ৮৩ দশমিক ০১ শতাংশ।

বিদেশের আটটি পরীক্ষা কেন্দ্রে এবার পাসের হার ৮৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এবার ৪ হাজার ৭৩৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবাই পাস করেছে আর ৫৩ প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করতে পারেনি।

দেশের আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে এসএসসিতে এবার ১৩ লাখ ২৮৪ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। পাস করেছে ১১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৬৩ জন। মাদ্রাসা বোর্ডে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৬ দাখিল পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ২ লাখ ১৭ হাজার ৩১৪ জন। কারিগরি বোর্ডের এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় ৯৮ হাজার ৫৮১ পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাস করেছে ৮১ হাজার ৯২৮ জন।

আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ ৫ পেয়েছে ৯৬ হাজার ৭৬৯ জন। মাদ্রাসা বোর্ডে ৫ হাজার ৮৯৫ ও কারিগরি বোর্ডে ৭ হাজার ৯৭ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে। পাসের হারে শীর্ষে থাকা রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার ৯৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে বরাবরের মতো শীর্ষে থাকা ঢাকা বোর্ডে এবার ৪০ হাজার ৮৩৩ শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে।

গত ১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়। তাত্তি্বক বা লিখিত পরীক্ষা শেষ হয় ৮ মার্চ।

ফলের বৈশিষ্ট্য :এ বছর বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জয়জয়কার। প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীরা এবার ভালো করেছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, এবার ইংরেজির চেয়ে গণিতের ফল বেশি খারাপ হয়েছে। গণিতে সৃজনশীল পদ্ধতি এখনও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে আয়ত্ত করতে না পারাকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে সমাজবিজ্ঞানে খারাপ ফল হওয়ায় মাদ্রাসা বোর্ডে এবার জিপিএ ৫-এর সংখ্যা গত বছরের চেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে। মাদ্রাসার ফলে ধস নামার কারণে সার্বিক গড় ফলেও তার প্রভাব পড়েছে। তবুও এবারের ফলকে ভালো ফল হিসেবে আখ্যায়িত করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, এ বছর প্রশ্ন ভালো হয়েছে। আর সৃজনশীল পদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থীরা বুঝেশুনে উত্তর দিয়েছে। যে কারণে তারা ভালো নম্বর পেয়েছে। এদিকে, শিক্ষকরা বলছেন, গণিত ও উচ্চতর গণিতে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি না থাকলে পরীক্ষার্থীরা আরও বেশি ভালো ফল করত। বিষয় দুটি এমনিতেই সৃজনশীল। সেখানে নতুন করে এ পদ্ধতি চালুর দরকার ছিল না। এ নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, প্রথমে না হলেও পরে শিক্ষাবিদদের পরামর্শেই এ দুটি বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এখন এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলতে পারে। প্রয়োজনীয়তা না থাকলে ভবিষ্যতে তা উঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

১২ থেকে ১৮ মে উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন :এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণে ১২ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত আবেদন করা যাবে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে জানা গেছে, টেলিটক প্রি-পেইড মোবাইল ফোন দিয়ে ফল যাচাই করার আবেদন করা যাবে। আবেদন করতে মোবাইলে মেসেজ অপশনে গিয়ে আরএসসি (জঝঈ) লিখে স্পেস দিয়ে বোর্ডের নামের প্রথম তিন অক্ষর লিখে স্পেস দিয়ে রোল নম্বর লিখে স্পেস দিয়ে বিষয় কোড লিখে ১৬২২২ নম্বরে পাঠাতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি পত্রের জন্য ১২৫ টাকা হারে ফি দিতে হবে। ফিরতি এসএমএসে আবেদন ফি বাবদ কত টাকা কেটে নেওয়া হবে তা জানিয়ে একটি পিন নম্বর দেওয়া হবে। আবেদনে সম্মত থাকলে মেসেজে গিয়ে আরএসসি (জঝঈ) লিখে স্পেস দিয়ে ইয়েস (ণঊঝ) লিখে স্পেস দিয়ে পিন নম্বর লিখে স্পেস দিয়ে নিজ মোবাইল ফোন নম্বর লিখে ১৬২২২ নম্বরে পাঠাতে হবে।

যেসব বিষয়ে দুটি পত্র (বাংলা ও ইংরেজি) রয়েছে সেসব বিষয়ে একটি বিষয় কোডের (বাংলার জন্য ১০১, ইংরেজির জন্য ১০৭) বিপরীতে দুটি পত্রের জন্য আবেদন হিসেবে গণ্য হবে এবং আবেদন ফি হিসেবে ২৫০ টাকা লাগবে। একই এসএমএসের মাধ্যমে একাধিক বিষয়ের জন্য আবেদন করা যাবে। এক্ষেত্রে বিষয় কোড পর্যায়ক্রমে কমা (,) দিয়ে লিখতে হবে।

ফলাফলে অসন্তুষ্ট নই :শিক্ষামন্ত্রী

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রকাশিত ফলের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘ফলাফলে অসন্তুষ্ট নই; কিন্তু আমরা আরও ভালো চাই।’

ফল প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল সচিবালয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।

পরীক্ষায় যারা পাস করতে পারেনি তাদের হতাশ না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘পরীক্ষায় পাস-ফেল করা অনেক সময় নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। আমরা আশা করব ভবিষ্যতে তারা ভালো প্রস্তুতি নিয়ে ভালো ফল করবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা খুশি আছি; কিন্তু আমরা অনেক বেশি খুশি হতে চাই। সবাই যেন ভালো করতে পারে, সে চেষ্টাই আমরা করে যাচ্ছি।’

নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায়, আমাদের সবার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে শিক্ষা খাতে উন্নতি হচ্ছে। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বলছি, এর হয়তো আরও বিশ্লেষণের দরকার আছে।’

নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘প্রতিবারই আমরা ৬০ দিনের মধ্যে ফল দিয়েছি। এবার ৫৭ দিনের মধ্যে আমরা ফল দিলাম।’

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষা সচিব মো. সোহরাব হোসাইন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন, আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমানসহ আট বোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডের চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *