এখন কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসির আসামি নিজামীকে এই রায় পড়ে শুনিয়ে জানতে চাইবে, তিনি কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন, এই রায় প্রকাশের মধ্য দিয়ে আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেল। বিচারিক প্রক্রিয়ার নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ায় একাত্তরে আলবদরপ্রধান নিজামীর সামনে এখন শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগই বাকি।
আপিল বিভাগের দেওয়া রিভিউ খারিজের রায়ে বিচারকদের স্বাক্ষরের পর সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তা প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট। ২২ পৃষ্ঠার ওই রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়।
আপিল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী এরপর তা পৌঁছে দেন এ মামলার বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
অরুনাভ চক্রবর্তী বলেন, রায়ের তিনটি অনুলিপি দেওয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালে। সেগুলো ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দুই পক্ষের আইনজীবীকেও অনুলিপি পাঠানো হয়েছে।
পরে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার শহীদুল আলম ঝিনুক জানান, রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এতে সই হওয়ার পর ওই আদেশ ও রায়ের কপি কারা কতৃপক্ষ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ জানান, রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি যাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। সেখানে থেকে যাবে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে। নিয়ম অনুযায়ী, কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীকে রায় পড়ে শোনাবেন। এরপর তিনি সর্বশেষ সুযোগ হিসেবে দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন। তবে নিজামী প্রাণভিক্ষা না চাইলে বা প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ হলে যে কোনো সময় দণ্ড কার্যকর হবে।
গত বৃহস্পতিবার মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ রিভিউ আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মঙ্গলবার শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার তা নিষ্পত্তি করেন।
এদিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীকে রোববার রাতে কাশিমপুর থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়েছে।
কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ-র্যাবের একটি দল তাকে কাশিমপুর-২ কারাগার থেকে ঢাকায় আনে।
গত ১৫ মার্চ নিজামীর আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন সর্বোচ্চ আদালত। তার আপিল খারিজ করে ফাঁসি বহাল রেখে দেওয়া এ রায়ের ভিত্তিতে ওইদিনই নিজামীর মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত ২৯ মার্চ রিভিউ আবেদন করার পর থেকে মৃত্যু পরোয়ানা স্থগিত ছিল। বৃহস্পতিবার রিভিউ খারিজ হওয়ায় আবার সচল হয়েছে এই পরোয়ানা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় বুদ্ধিজীবী হত্যা ও তার নিজ এলাকা পাবনায় হত্যা, গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর যুদ্ধাপরাধী নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তারই পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল বলেও রায়ে বলা হয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় নিজামীর বিরুদ্ধে আনা ১৬টি অভিযোগের মধ্যে আটটি ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে পাবনার বাউসগাড়ি ও ডেমরা গ্রামে ৪৫০ জনকে নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণ, করমজা গ্রামে ১০ জনকে হত্যা ও তিনজনকে ধর্ষণ, ধুলাউড়ি গ্রামে ৫২ জনকে হত্যা এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার দায়ে (২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ) নিজামীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের ওই রায় বাতিল ও বেকসুর খালাস চেয়ে নিজামীর পক্ষ থেকে আপিল করা হলে চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি আপিল আংশিক মঞ্জুর করে সেই ফাঁসির রায় বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত। আপিল বিভাগের রায়ে, করমজা গ্রামে ১০ জনকে হত্যা ও তিনজনকে ধর্ষণের দায় (৪ নম্বর অভিযোগ) থেকে নিজামীকে খালাস দেওয়া হয়। বাকি তিন অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ২৮ মে নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল।