গ্রাম বাংলা ডেস্ক:বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের লেখা দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত ধরাবাহিক সিরিজের ৮৩তম পর্ব, পিতাকে পুত্র-৮৩।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
গত পর্ব পরে পত্রিকা অফিসে কতজন যোগাযোগ করেছে জানি না, তবে অসংখ্য পাঠক ফোন করেছেন। যাতে অন্যান্য কাজ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের দুরবস্থায় তারা খুবই শঙ্কিত, ব্যথিত, মর্মাহত। বিশেষ করে এক শ্রেণীর পাঠক ফোন করে বলছিলেন, আরেকটু লিখে প্রসঙ্গটা শেষ করে ফেললে আরো মজা পাওয়া যেত। ওই ধরনের পাঠক বন্ধুদের কী বলি? মজা কাকে বলে জীবনে কখনো খুঁজে দেখার সুযোগ পাইনি। শত কষ্টে জীবনটা মোটামুটি স্বস্তি আর আনন্দেই কাটিয়েছি। আইয়ুব, মোনায়েম আমাদের সোজা করতে বারবার জেলে পাঠাতেন। কিন্তু আমরা তেমন একটা সোজা হতাম না। আমরা আমাদের মতোই থাকতাম। আমাদের মতো থেকে আমরা আইয়ুব খানকে তাড়িয়েছি। ইয়াহিয়া ট্যাংক কামান বন্দুক নিয়ে এসে রক্তের গঙ্গা বইয়ে আমাদের দমাতে পারেনি। আমরা তার ট্যাংক কামান গুঁড়িয়ে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। সেদিন জনাব মায়াও বলেছেন, বিরোধীদের পা গুঁড়িয়ে হাতে ধরিয়ে দেবেন। চাঁদপুর মতলবের মানুষ দিতেও পারেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন তাই করে কেটে খেয়ে গেলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে টাকাসহ গ্রেফতার করে শাহবাগে বেতার ভবনে আটকে রাখা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হয়েছে ঢাকার একজন মুক্তিযোদ্ধা অনেকের অনুরোধে মুক্তি পেয়েছিল। কিছু দিন পর তোমার সরকার গ্রেফতার করে জেলে ফেলে রেখেছিল। শেখ কামালের সাথে ঘুরাফেরা করত। শেখ কামালের দয়া ছিল মায়ার ওপর। তোমার বড় ছেলে হলেও তোমাকে অনেক কিছু বলতে চাইতো না। ভদ্রতা-শালীনতা-বিনয়, ভীষণ দয়ামায়া ছিল শেখ কামালের মধ্যে। যদিও অনেকে বড় নির্দয়ভাবে বড় বেশি বদনাম করে। কামালের অনুরোধে মায়াকে ছেড়ে দিতে আমিও অনুরোধ করেছিলাম। স্বাধীনতার পর তুমি যে ক’দিন বেঁচে ছিলে আমার মনে পড়ে না, আমার কোন অনুরোধ তুমি রা করোনি। তাই মায়াকেও দয়া করেছিলে। হঠাৎই আমাদের ফেলে তুমি চলে যাও। কেউ কিছু করেনি, আমরা যারা কিছু করেছি তাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা হচ্ছে, এখনো করছে। মায়ার জামাই নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের আসামি। যে কারণে কিছু দিন মুখ ভার করেছিল। আবার বোল ফুটেছে।
আমার যোদ্ধাদের অভাব অনটনের চেয়ে তাদের মর্যাদাহানি বুকে বেশি বাধে। যুদ্ধের আগে মুক্তিযোদ্ধারা অভাবী ছিল, এখনো অভাবী আছে। কিন্তু স্বাধীনতা মুক্তিযোদ্ধাদের যে মর্যাদা দিয়েছিল সেই মর্যাদা নানা কলাকৌশলে ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হয়েছে, এখনো হচ্ছে। মাত্র কিছু সামরিক বাহিনীর সদস্য স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বসূচক প্রায় সব খেতাব পেয়ে গেছে। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা তেমন কিছুই পায়নি। যারা পেয়েছে তাদের সে যে কী অনাদরÑ ভাবলেই অবাক লাগে। জেনারেল বীর উত্তম, বীর বিক্রম তাদের ভাবসাবই আলাদা। পাবলিক বা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা যারা খেতাব পেয়েছে, যারা সাধারণ জামাকাপড় পরে তাদের কোনো খবর নেই। যে কারণে আস্তে আস্তে তারা নিজেরাও নিজেদের মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। সেই কথাই সে দিন বলতে চেয়েছি, কোনো মজা করতে চাইনি, কাউকে মজা দিতেও চাইনি। মজা করতে মজা দিতে কাল্পনিক উপন্যাস লিখতাম। যার সাথে বাস্তবের কোনো মিল থাকত না। সত্য মিথ্যা মিশিয়ে গল্প বানাতাম। আমার এসবে তো গল্পের ‘গ’ নেই, সবই বাস্তব। কলম আরো বেশি ঘুরাতে পারলে, আরো ইন্দ্রজালিক ছায়া মায়ার সৃষ্টি করতে পারলে পাঠক আরো আকৃষ্ট হতো। এমন সাদামাটা লেখার আর কত পাবলিক আকৃষ্ট হবে? মুক্তিযুদ্ধের একজন যোদ্ধা হিসেবে দেশের মানুষ জানে মানে ভালোবাসে, তাই লেখা পড়ে। আমার কথা, সব মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি গাড়ি না হয়, নাই দেয়া হলো। কিন্তু খেতাবপ্রাপ্ত তাদের নয় কেন? সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দুই হাজার টাকা সম্মানী ভাতা চেয়ে সে যে লাঞ্ছিত হয়েছি। যে দেশ স্বাধীন করেছি, সেই দেশের তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধারা কিংবা দলীয় দালাল মুক্তিযোদ্ধারা আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে, কালো পতাকা উড়িয়েছে। প্রথম প্রথম মনে করতাম সম্মানী ভাতা চাওয়া হয়তো কম হয়েছে তাই তারা প্রতিবাদী। কিন্তু পরে দেখলাম না তা নয়, আমার বক্তব্যটা তখনকার সরকারের বিরুদ্ধে গেছে। এখন যাদের সরকারি তালিকায় নাম আছে, তাদেরকে প্রায় দুই হাজার টাকা ভাতা দেয়া হয়। যদিও আমি যখন দু’হাজার টাকার কথা বলেছিলাম, এখন সেই অনুপাতে ১৫-১৬ হাজার টাকা সম্মানী হওয়া উচিত। কিন্তু তা হবে কেন? ফকিরকে ভিা দেয়া আর ধোপীকে কাপড় দেয়া এক কথা নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে, স্বাবলম্বী হতে, সম্মানের আসনে বসাতে দেশ এবং সরকার কখনো কিছু করেনি। মুক্তিযোদ্ধারা হবে ভূমিমহীন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষণ হবে দুস্থ অসচ্ছল, দালালেরা সব সচ্ছল। কী করি, এ অভিযোগ কাকে জানাই? বলারও তেমন কেউ নেই, শোনারও কেউ নেই। সব কেমন যেন গুমোট হাওয়ায় ঘাপটি মেরে আছে। এমন আবহাওয়া সব সময়ই খারাপ। প্রকৃতিতে যখন অমন গুমোট হাওয়া বয় তখন তুফান আসে। সমাজেও অমন হাওয়া ভালো না। অথচ সেই খারাপ হাওয়াই চার দিকে। দরজা জানালা খোলার উপায় নেই। এক দারুণ শ্বাসরুদ্ধকর অসহনীয় অবস্থা।
আজ ক’দিন বিলাতে বসে একজন এত বেশি অশোভন কথা বলছেন, যা এর আগে বাঙালির সভ্যতায় ছিল না। কথাগুলো বাবাজি নিজের বিদ্যা বুদ্ধিতে বলছেন, না কারো শিখিয়ে দেয়া বুলি আওড়াচ্ছেন বুঝতে পাচ্ছি না। চাটুকারের চাটুতে যারা চলে বলে এক সময় তাদের বড় দুর্ভাগ্য হয়। বাবাজি তারেক রহমান এক কঠিন দুর্ভাগ্যের মোকাবেলা তো করেছেন। তাহলে তার আগা মাথা চিন্তা করার একটা শক্তি তো অর্জন করা অবশ্যই উচিত। অতীত থেকে যে শিা নেয় না, তার জন্য ভয়াবহ দুর্যোগ পদে পদে অপোয় থাকে। শুনেছি, বাবাজি তেমন লেখাপড়া করেনি। কিন্তু তাই বলে প্রকৃতির শিা কেন নেবে না। অত উচ্চাসনে বা পর্যায়ে পৌঁছে গেলে সব যুগে সবার জন্য সব সময় বিনা বেতনে প্রকৃতিই তার শিক হয়। তবে কি তারেক প্রকৃতির কাছ থেকেও শিা নিতে অম? ইদানীং যেভাবে সে আওয়ামী লীগকে কুলাঙ্গার, কুলাঙ্গার দল বলে চলছে, তুমি এবং তোমার পরিবার অভিশপ্ত পরিবার এসব বলায় কিছু উন্মাদ হয়তো তাকে বাহবা দিতেও পারে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাংলা এবং বাঙালির হৃদয় তবিত খানখান হচ্ছে। বিবেকবান মানুষ মর্মাহত হয়েছে। তার এসব উক্তি সুস্থ মানুষ সমর্থন করে না। বরং নিন্দা করে। কুলাঙ্গার, কুলের মুখে যে কালি দেয় তাকে বলে কুলাঙ্গার। কুলাঙ্গার একবচন, কিন্তু কুল বহুবচন। নিশ্চয় কুলের দু-একজন কুলাঙ্গার হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে পুরো কুল নয়। পুরো দল, পুরো পরিবার কখনো কুলাঙ্গার হয় না। তারেক এ েেত্র মাপ রেখে কথা বলতে পারেনি। এখনো জাতির বিবেকে পরিণত হননি। তার যা মেধা মনন, যা বয়স তাতে ৮০-৯০ হোক, এখনই তার এমনতর অছিয়তে জাতি চলবে কেন? তবে এটা ঠিক, সরকার যেমন দিশেহারা, ঠিক তেমনি দিশেহারা বিএনপি বা তার নেতারা। তারা দেশ এবং জাতির জন্য কিছুই করতে পারবে না। সরকার পে যারা তারেক রহমানের কথাবার্তার জবাব দিচ্ছেন তাদের জবাবেও তেমন যুক্তি আছে মনে হয় না। হাসানুল হক ইনু ভাড়া করা লোক। তোমার বিরোধিতা করে তোমাকে ধ্বংস করেছে। এবার তোমার মেয়ের সহযোগী সেজে তার সর্বনাশ করছেন কি নাÑ অত চতুর মানুষের কর্মকাণ্ড বোঝা মুশকিল। তবে তোফায়েল আহমেদের মতো প্রবীণ রাজনীতিক যখন ‘ওর তোর’ বলে তারেক রহমানের কথা খণ্ডন করেন তখন কিছুটা অবাক না হয়ে উপায় কী? তার কথায় মনে হয়েছে ‘যেহেতু তুই আমায় কুলাঙ্গার বলেছিস, তাই তুইও কুলাঙ্গার। কুলাঙ্গার না হলে আমায় কুলাঙ্গার বলিস কী করে? কুলাঙ্গারই কাউকে কুলাঙ্গার বলে।’ এটা ঝগড়া হলো। তুই কুলাঙ্গার, না না তুই কুলাঙ্গারÑ এখানে ঝগড়া আছে, কোনো যুক্তি নেই, কোনো সারবত্তা নেই। এ-ও তো হতে পারে ভালোমন্দ যেভাবেই হোক এসব করে যদি তারেক রহমান আলোচনার কেন্দ্র হতে চায় তাহলে তো সে সফল হয়েছে বলতে হবে। জনাব তোফায়েল আহমেদ কি মনে করেন, তিনি তারেক রহমানের সমপর্যায়ে? মাহবুবুল আলম হানিফ এত কথা বলে, মায়া ছায়ারা কি না বলে? তারেক রহমানের কথার তারা জবাব দিতে পারে না? তবে এটাও ঠিক, আমার ভগ্নী জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের কারো কথার এখন আর কোনো ধার নেই, কোনো ওজন নেই, কেউ কিছু মনে করে না। আওয়ামী লীগের নেতাদের বাজার দর বড় বেশি কমে গেছে। ’৯৯-এ সখিপুর-বাসাইল উপনির্বাচনের সময় ২৮ জন মন্ত্রীর ২৫ জন গিয়েছিলেন। কোনো মন্ত্রীর মিটিংয়ে লোক হতো না। এক জুমার নামাজে ৮০-৮৫ বছরের এক লোক আমার পিঠে সাবাসীর থাপ্পড় মেরে বলেছিলেন, ‘কাদের সিদ্দিকী, তুমি বাপের বেটা। কাঁকড়াজানে বেগুন সস্তা, তুমি হাসিনার মন্ত্রীগোরে তারও চাইতে সস্তা করে ফেলছো। কত আতরে বাতরে একসাথে চারটা মন্ত্রী বইস্যা থাকে। কেউ তাদের পোছেও না।’ আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রায় তেমন হয়েছে। তবে আওয়ামী নেতারা জনাব তারেক রহমানের ছালচাছা আজেবাজে কথাবর্তার দাঁতভাঙা জবাব দিতে না পারলেও সব সময় এমন করলে প্রকৃতিই জবাব দেবে
মানুষ বড় পদের কারো কাছ থেকে অমন নিম্নমানের কথা শুনতে চায় না। নিজের খেয়ে তাদের ভালোবাসার কারো অপমান সহ্য করতে চায় না। তাই বিএনপি এবং তারেক রহমান জাতির জনককে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তার ভূমিকা নিয়ে যত কম বলবে ততই লাভবান হবে।