সুন্দরী ছাত্রীকে টার্গেট করতো শিক্ষক মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌস। এরপর নানা কায়দায় তাকে কাবু করতো। এসব করতে গিয়ে তিনি এখন ধরা পড়েছেন। আহছান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষক ফেরদৌসকে নিয়েই ব্যাপক আলোচনা। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তেজগাঁও ক্যাম্পাসে কথা হয় ট্রিপল-ই বিভাগের একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে। তাদের অভিযোগ, ফেরদৌসের মূল টার্গেট ছিল সুন্দরী ছাত্রীরা। সে যে কোনো ডিপার্টমেন্টের হোক না কেন। তার চোখে পড়লেই ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতো। সময়-সুযোগে ফাস্টফুডের দোকানে খাবারের অফার দিতো।
খাবারের সায় পেলেই নানান উপহার-উপঢৌকন পাঠাতো। এরপর পড়া, থিসিস বোঝানোর কথা বলে পান্থপথের বাসায় আসার অফার। বাসায় এলেই কখনো জোর করে, কখনো ব্ল্যাকমেইল করে যৌন হয়রানি করতো। ওদিকে এই শিক্ষকের স্থায়ী বহিষ্কারের দাবিতে আহসান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে। অভিযোগ উঠেছে, ওই শিক্ষক একজন নয় অনেক শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়ন করেছে। আজ সকালে সব বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবেন। সেখান থেকে দ্রুত সময়ে তাকে স্থায়ী বহিষ্কার করার দাবি জানাবেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, এই শিক্ষকের কাছে একাধিক ছাত্রী নির্যাতিত হলেও ১ম বর্ষের এক সাহসী মেয়ে তার গোমর ফাঁস করেছেন। বরখাস্তের পর তাকে ঘিরে ক্রমেই নানান চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। কোষাধ্যক্ষ কার্যালয়ের একটি সূত্র বলছে, তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ৫-৬জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক করার অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার ঘটনার উল্লেখ আছে। এতদিন ভিকটিম লাজলজ্জার ভয়ে মুখ না খুললেও এখন বলা শুরু করেছেন। সময়-সুযোগ ও পরিস্থিতি বুঝে আরো অনেকেই বলবেন। এতদিনে যারা নীরবে সহ্য করেছেন তারা হয়তো বিস্ফোরণ ঘটাবেন।
এ ব্যাপারে আহসান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি প্রফেসর এএমএম সাইফুদ্দিন বলেন, প্রথম দিকে যে দুটি অভিযোগ এসেছিল তাতে কারো নাম উল্লেখ ছিল না। এখনো যেগুলো আসছে সেগুলোও নাম স্বাক্ষর বিহীন অভিযোগ। তার পরও এসব অভিযোগ আমরা অমলে নিয়ে যৌন নিপীড়ন বিষয়ক সেল, যারা ফেরদৌসের বিষয়টি তদন্ত করছেন তাদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এসব অভিযোগ প্রমাণ হলে তাকে স্থায়ী বহিষ্কারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের যা করার সুযোগ আছে সবটুকু করবে। তবে পুলিশি মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া এই শিক্ষক রিমান্ডে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় দু’দিনের রিমান্ডে আছেন তিনি। মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা কলাবাগান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শামীম আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, বেশ কিছু যৌন হয়রানির অভিযোগে আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করছে।
তার দাবি, যেসব ছাত্রী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন তারা মূলত পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলেন না। পড়াশোনার জন্য শাসন করতাম, এজন্য তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ। শামীম বলেন, সব অপরাধী অভিযোগ অস্বীকার করে। তার পরও আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাব। রিমান্ডের আরো একদিন বাকি। প্রয়োজনের আরো রিমান্ড চাওয়া হবে।
মামলার নথি থেকে জানা গেছে, গত ২রা মার্চ দুপুর আড়াইটায় শিক্ষক ফেরদৌস ভিকটিম ছাত্রীকে পান্থপথের বিল্ডিং নং ১৫২/২/জি/১-২, ৪নং ফ্ল্যাটে যেতে বলেন। থিসিস বোঝানো নামে এক পর্যায়ে ওই ছাত্রীর স্পর্শকাতর স্থানে হাতে দিয়ে শ্লীলতাহানি করেন ওই শিক্ষক। ওই সময় ছাত্রী ধস্তাধস্তি করে সেখানে থেকে চলে আসেন। বাসায় অবস্থানকালে ছাত্রীর মোবাইল থেকে অফিসের মোবাইলে আপত্তিকর ম্যাসেজ পাঠিয়ে রাখে। পরবর্তীতে এই ম্যাসেজকে পুঁজি করে আবার তার বাসায় আসার প্রস্তাব দেয় শিক্ষক। এবং এই বিষয়টি অভিভাবক বা বিশ্ববিদ্যালয়কে জানালে পরিণাম খারাপ হবে বলে হুমকি দেয়।
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের শিক্ষার্থী প্রশান্ত রায় গতকাল বলেন, তিনি একাধিক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করছেন আমাদের অনেক প্রমাণ আছে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নানা কৌশলে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করে আসছিলেন। কমিটির কাছে একাধিক ছাত্রী জবানবন্দি দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েও রেখেছেন। তারা ক্রমেই ফুঁঁসে উঠছেন। তাকে স্থায়ী বহিষ্কার না করলে আমরা ক্লাসে ফিরে যাব না।
মেকানিক্যাল বিভাগের একজন ছাত্রীর সঙ্গে কথা হয় গতকাল সকালে। তিনি অভিযোগ করেন, অভিযুক্ত শিক্ষক সহকারী প্রক্টর হওয়ার কারণে সবাই তার কাছে যেত হতো। এই সুযোগে তিনি বলতেন, তোমাদের টাকা সময়মতো জমা না দিতে পারলে আমি ম্যানেজ করে দেব। বিশেষ করে সুন্দরী ছাত্রীরা ছিল তার প্রথম টার্গেট। তিনি সুন্দরীদের বলতেন তোমাদের জন্য অনেক কিছুই আমি করতে পারি। তোমাদের সমস্যার সমাধানের সব ধরনের চেষ্টা করবো। সব বিভাগের ছাত্রীদের প্রতি তার কু-নজর ছিল। তিনি বলেন, তিনি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে তার কক্ষে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাতেন। বলতেন যে কোনো সমস্যা নিয়ে আমার কক্ষে চলে এসো। এরপর আস্তে আস্তে তাকে বাগে আনার চেষ্টা করতো।
কোনো শিক্ষার্থী রাজি না হলেই তার অভিভাবককে ফোন দিয়ে নানা অভিযোগ করতো। আপনার মেয়ে পড়াশোনা করে না। ক্লাসে মনোযোগী না। এরপর অভিভাবক এই শিক্ষকের কাছে পাঠাতো। এই শিক্ষার্থী বলেন, ফেরদৌস ছাত্র জীবনেও এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। তিনি ম্যানেজ করতে জানেন। কাকে কি বলতে হবে এ ব্যাপারে তিনি সিদ্ধহস্ত। তার সঙ্গে একবার কথা বললে এমন সব আচরণ করতেন যে, আরেক বার কোনো সমস্যা হলে তার কথাই মনে পড়তো। গতকাল ক্যাম্পাসে আসা শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে ছিল বরিশালের একজন ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের প্রস্তাব। কিন্তু ওই ছাত্রী কোনো উচ্চবাচ্য না করে নীরবে সহ্য করেন। ওই ছাত্রী এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয়।
মানবাধিকার নেত্রী এডভোকেট এলিনা খান বলেন, এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে সবগুলো গুরুত্বর। এটা যদি সত্যি হয় তবে তিনি শিক্ষক নামের পশু। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত তাকে স্থায়ী বহিষ্কার করা। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ওই শিক্ষক ছাত্রীকে চাপ নিয়ে মিথ্যা বিবৃতি লিখিয়ে নেন। আমাদের দাবি, অবিলম্বে এই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করতে হবে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ভিসি প্রফেসর এএমএম শফিকউল্লাহ বলেন, ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির দুটি বেনামি অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাছাড়া একজন ছাত্রীর কাছ থেকে পক্ষে জবানবন্দি নেয়ার চেষ্টার একটি ভিডিও কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে। আমরা প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছি। ৯ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি কাজ করছে, তাদের রিপোর্ট পেলেই আমরা আরো পদক্ষেপ নেব।
শ্বশুরের কাছ থেকে উপহার পাওয়া ফ্ল্যাটে ছলে-বলে-কৌশলে শিক্ষার্থীদের ঘৃণিত এ কাজে বাধ্য করে আসছিলেন শিক্ষক মাহফুজুর রশিদ ফেরদৌস। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবার নিয়ে হলি ফ্যামিল রেড ক্রিসেন্ট এলাকার একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। তা স্ত্রী আহসান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের শিক্ষক। পান্থপথ আবাসিক এলাকায় প্যারাডাইস সুইটসের পাশে শ্বশুরের কাছ থেকে উপহার পাওয়া ওই ফ্ল্যাটে শিক্ষার্থীদের ব্ল্যাকমেইল করে এনে জোরপূর্বক যৌন হয়রানি করে আসছিলেন। মাহফুজের ব্ল্যাকমেইল করার পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পড়া বোঝানোর নামে শিক্ষার্থীদের ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতেন। দ্বিমত করলে শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়া হতো। ফলাফল সেমিস্টার ড্রপ আউট।