১৪টি ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা ছাড়া প্রতিটি ঘটনায় হামলাকারীরা তাদের ‘লক্ষ্যবস্তু’ হিসেবে বেছে নেওয়া ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। কেবল গত বছর ৩১ অক্টোবর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘শুদ্ধস্বর’-এর মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপানো হলেও ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে যান। অন্য ১৩টি হামলার ঘটনায় ১৪ জন নিহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ব্লগার, প্রকাশক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, পুলিশ ও ভিন্নমতের ব্যক্তিরা রয়েছেন। পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, এসব হামলার ধরন একই রকম এবং পরিকল্পিত।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, গত তিন বছরে চাপাতি দিয়ে এ ধরনের হামলার ঘটনা কয়েক মাস পরপর বা অল্প সময়ের ব্যবধানে দুই-তিনটি ঘটনা ঘটেছে। তা ছাড়া অনেক গণমাধ্যম হওয়ায় বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এ ধরনের হামলার শুরু বলা যায় ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ওই হামলার ধরন ও কারণ এখনকার হামলাগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। একই বছর ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনুসকে বিনোদপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এটিও ছিল একই রকম। এরপর প্রায় নয় বছরের বিরতি ছিল। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলনরত গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীব হায়দারকে পল্লবীর বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মূলত এরপর থেকে চাপাতি দিয়ে হামলার বিষয়টি সামনে আসে। যাঁরা হত্যার শিকার রয়েছেন, তাঁরা ভিন্ন পেশার মানুষ হলেও হত্যাকারীরা তাদের ‘মতাদর্শ’ অনুযায়ী এঁদের লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করে।
হামলাকারীদের চাপাতির কোপে সর্বশেষ প্রাণ হারান ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক কর্মকর্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মসূচি কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও নাট্যকর্মী খন্দকার মাহবুব রাব্বী তনয়। গত সোমবার বিকেলে কলাবাগানে জুলহাজের বাসায় ঢুকে এই দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীরাও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তবে এবার এক পুলিশ সদস্য হামলাকারীকে ধরে রাখতে না পারলেও তার ব্যাগটি কেড়ে নিতে সক্ষম হন। পুলিশ বলছে, এখানে গুরুত্বপূর্ণ আলামত পাওয়া গেছে, যা দিয়ে হামলাকারীদের ধরা সম্ভব হবে। ওই ঘটনায় অন্তত চার খুনির ‘স্পষ্ট’ ছবি পুলিশের কাছে রয়েছে বলে জানা গেছে।
জুলহাজ মান্নান হত্যার দুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। জুলহাজের মতো এই ঘটনার জন্যও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিদের সন্দেহের তালিকায় রেখেছে।
এ ছাড়া ২০১৪ সালের ১ আগস্ট সাভারে ব্লগার আশরাফুল আলমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই বছরের ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির কাছে চাপাতির কোপে মারা যান বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়। এ ঘটনায় আহত হন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। ওই বছরের ৩০ এপ্রিল ঢাকার তেজগাঁওয়ে সড়কে একইভাবে অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান খুন হন। ১২ মে সিলেটে অফিসে যাওয়ার পথে খুন হন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। ৭ আগস্ট পূর্ব গোড়ানের বাসায় ঢুকে জুলহাজের মতো গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে হত্যা করা হয়। ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতির নিজ কার্যালয়ে খুন হন এর মালিক ফয়সল আরেফিন দীপন। ৪ নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ায় পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে কুপিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়।
আর চলতি বছর ৬ এপ্রিল সূত্রাপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সন্ধ্যাকালীন শিক্ষার্থী নাজিমউদ্দিন সামাদকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, হামলাকারীদের ধরতে সব ধরনের চেষ্টাই তাঁরা করছেন। দুই একটি ক্ষেত্রে হামলাকারীরা বিদেশে পালিয়ে গেছে। কোনো কোনো ঘটনার বিচারকাজও শুরু হয়েছে।
‘চাপাতি’ হামলায় তিন বছরে নিহত ১৪
তিন বছরে চাপাতি দিয়ে ১৪টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ১৪ জন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে, এই হামলাগুলোর ধরনও ছিল একই রকম। হামলার পর একজন ছাড়া সব হত্যাকারী নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কেবল তেজগাঁওয়ে ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যার পর এক হত্যাকারীকে ধরে ফেলেন লাবণ্য হিজড়া। এ ছাড়া আর কাউকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করা যায়নি।