সৃষ্টি না করা এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে সুনির্দিষ্ট ‘বিশেষ সাংগঠনিক ক্ষমতা’ না দেওয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের ‘উপদেষ্টা পরিষদ’ যুক্ত না করায় মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন তারেক রহমান। দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ও জ্যেষ্ঠপুত্রের সঙ্গে কথা বলতে শিগগির দলের একজন সিনিয়র নেতাকে লন্ডন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন খালেদা জিয়া। ঢাকা ও লন্ডনের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, এহেন পরিস্থিতিতে দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল এক মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে দলের স্থায়ী কমিটি, উপদেষ্টা পরিষদ এবং নির্বাহী কমিটির অবশিষ্ট পদ বণ্টনের ব্যাপারে তারেক রহমান তার পছন্দ-অপছন্দ কিছুই জানাচ্ছেন না। অথচ ২০০৯ সালের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে দলের কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। এমনকি প্রতিটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের ব্যাপারে তার কম-বেশি পছন্দের নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি দেওয়া হচ্ছিল।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দলের হাইকমান্ডের মধ্যে ‘দূরত্ব’ তৈরি হওয়ায় নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনসহ সার্বিকভাবে দল পরিচালনায় সুযোগ নিচ্ছে দলের একটি ‘স্বার্থান্বেষী সিন্ডিকেট’। ওই সিন্ডিকেটে রয়েছেন দলের মধ্যম সারির নেতা ও গুলশান কার্যালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা। তাদের বিরুদ্ধে দলের নতুন কমিটি গঠনে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একইসঙ্গে ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে। ওই সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ দলের কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুর ইসলাম টিপুর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ‘সন্দেহজনক’ লেনদেন হওয়ার খবর দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। বিগত এক বছরের ব্যাংক লেনদেনের বিবরণী দেখে বিএনপির অনেক নেতাই বিস্ময় প্রকাশ করেন।
সূত্র জানায়, দলের নেতাদের একটি অংশ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের আগে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদটি বাদ দিয়ে ‘কো-চেয়ারম্যান’ পদ সৃষ্টির দাবি তুলেছিলেন। একইসঙ্গে ওই পদের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করার দাবি তুলেছিলেন তারা। চেয়ারপারসনের পাশাপাশি কো-চেয়ারম্যানেরও একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন তারা। বিষয়টি নিয়ে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদের বাসায় গঠনতন্ত্র সংশোধন উপকমিটির হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। ওই বৈঠকে চেয়ারপারসনের অন্য উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আজমের সঙ্গে ইকবাল হাসান টুকু ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপনের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। বিষয়টি খালেদা জিয়াকেও জানানো হয়।
সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর কমিটি নিয়েও ক্ষুব্ধ তারেক রহমান। তিনি ঢাকা মহানগরে একটি কমিটি চান। দুটি কমিটি গঠনের প্রস্তুতি হিসেবে বিভিন্ন থানা কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির ওপর রুষ্ট হন তিনি। একইসঙ্গে আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস অনুসারীরা সাবেক আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকার অনুসারীদের বাদ দিয়ে কমিটি গঠনের অভিযোগ তারেক রহমানের কাছে পেঁৗছানো হয়েছে। সম্প্রতি সাদেক হোসেন খোকা লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ ব্যাপারে অভিযোগ করেন বলে সূত্র জানিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ঢাকা মহানগর কমিটি গঠন প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
এদিকে দলের নতুন কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় তারেক রহমান সম্পৃক্ত না থাকায় তার অনুসারী দলের তরুণ নেতারা ক্ষুব্ধ। তাদের দাবি, নতুন কমিটি গঠনে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করতে হবে। একইসঙ্গে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও অন্ধকারে রেখে একটি সিন্ডিকেট দলের নতুন কমিটি গঠন করছেন বলেও অভিযোগ করছেন তারা। তারা সমকালকে বলেছেন, ইতিমধ্যে নতুন কমিটির মহাসচিব, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ ঘোষণায় যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি।
বিএনপির দু’জন কেন্দ্রীয় নেতা সমকালকে জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দলের ভবিষ্যৎ ‘কাণ্ডারি’ হিসেবে পরিচিত তারেক রহমানের দূরত্ব কমানোর উদ্দেশ্যে খালেদা জিয়া একজন সিনিয়র নেতাকে লন্ডন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কোনো কারণে লন্ডন গিয়ে কথা বলা সম্ভব না হলেও সিঙ্গাপুর বা অন্য কোনো দেশে গিয়ে হলেও বিএনপির নতুন কমিটি গঠনের ব্যাপারে তারেকের মতামত নেবেন খালেদা জিয়া। গঠনতন্ত্র সংশোধনীতে নতুন কিছু সংযোজন-বিয়োজন করা সম্ভব না হলেও অন্তত তারেক রহমানের মতামত অনুযায়ী কিছু পদ-পদবি বণ্টন করা হবে।
অ্যাকাউন্টে ‘সন্দেহজনক’ লেনদেনে তোলপাড় :বিএনপির একটি সূত্র দাবি করেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক তাইফুর ইসলাম টিপু দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করেন না। তিনি মূলত বিএনপির কেন্দ্রীয় সিন্ডিকেটের ক্যাশিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার ব্যাংকে ২০১৫ সালের ৫ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা জমা হয়েছে। অ্যাকাউন্ট থেকে ইতিমধ্যে ৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি যে তারিখে টাকা জমা দিয়েছেন, ওই তারিখেই ওই টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। সূত্র দাবি করেছে, ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ডিসেম্বরে পৌরসভা এবং চলতি বছর ২২ মার্চ থেকে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শুরু হয়েছে। এবার কেন্দ্র থেকে দলের মনোনয়ন চূড়ান্ত করে দেওয়ায় কেন্দ্রীয় ‘সিন্ডিকেটটি’ সহ-দপ্তর সম্পাদকের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে মনোনয়ন-বাণিজ্য করেছেন। এই সিন্ডিকেটটির বিরুদ্ধে দলের জাতীয় কাউন্সিলের আগে সারাদেশে মহানগর, জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ‘পদবাণিজ্য’ করার অভিযোগ করে ওই সূত্রটি।
অবশ্য অভিযোগ সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুর ইসলাম টিপু গতকাল সমকালকে বলেছেন, গত ১০ বছর ধরে তিনি ব্যবসা করেন। একজন ব্যবসায়ীর অ্যাকাউন্টে বড় অঙ্কের টাকার লেনদেন হতেই পারে। এক বছর কেন, আগের বছরের লেনদেনের বিবরণ দেখলেও তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। দলের ভেতর থেকে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটানো হচ্ছে বলে দাবি করেন টিপু।