কারাগারগুলোর নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তারা অতন্ত্র প্রহরীর মতো কাজ করছেন। এবার স্পর্শকাতর এ ‘কারারক্ষী’ নিয়োগে ভয়ঙ্কর জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাধারণ কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ও এতিম কোটায় কারারক্ষী নিয়োগে ভয়াবহ অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতি হয়েছে। দেশের শীর্ষ এক গোয়েন্দা সংস্থা অনুসন্ধান করে জালিয়াতির প্রমাণও পেয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। জালিয়াতির মধ্যে রয়েছে- ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সাজানো, পিতাকে মৃত দেখিয়ে এতিম কোটায় চাকরি এবং জেলার অধিবাসী না হয়েও ঠিকানা জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি নেয়া। ময়মনসিংহ জেলার নিয়োগ সম্পর্কে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ জেলার স্থায়ী অধিবাসী হিসেবে ২৩ জন ‘কারারক্ষী’ পদে চাকরি পেয়েছেন। এর মধ্যে ১৪ জন সাধারণ মেধা কোটায়, ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় এবং তিনজনকে এতিম কোটায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর বিপরীতে সাধারণ কোটায় চারজন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তিনজন ও এতিম কোটায় তিনজনের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সাধারণ কোটায় কেলেঙ্কারি: বিভিন্ন জেলায় নিয়োগপ্রাপ্ত ৩৮ জনের মধ্যে সাধারণ কোটায় নিয়োগ পাওয়া ২৫ জন ‘ঠিকানা জালিয়াতি’র মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন। জেলা কোটার সুবিধা নিতে এমন কারসাজি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ জেলার মতো অন্যান্য জেলায়ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা, এতিম কোটা এবং সাধারণ কোটায় জালিয়াতি/অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ঠিকানা জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্তরা হলেন- মোছা. রুবানা আক্তার, পিতা- জাফুরুল ইসলাম; মো. রাজু আহমেদ, পিতা- মো. আব্দুর; মো. মিলন হোসেন, পিতা- মো. আব্দুর রহমান; মো. ফিরোজ হাসান, পিতা- মো. আলতাফ হোসেন; আলমগীর হোসেন, পিতা- বাবুল হোসেন; মো. বোরহান উদ্দীন, পিতা- মো. রবিউল ইসলাম; মোল্লা কামরুল ইসলাম, পিতা- মোল্লা আবদুল রাজ্জাক; মো. শামী আহমেদ, পিতা- আবদুল রাজ্জাক; মো. রিপন মিয়া, পিতা- মো. খলিলুর রহমান; সাইফ উদ্দিন, পিতা- মৃত আবদুল মজিদ; রুবেল মিয়া, পিতা- আবদুল খালেক; মো. আল আমিন, পিতা- মৃত রফিকুল ইসলাম; মো. আবদুল ওহাব, পিতা- মো. সারোয়ার হোসেন; মো. সোহেল রানা, পিতা- মো. ইয়াকুর আলী; মো. মোহন মিয়া, পিতা- মো. আবদুল আজিজ; মো. আবুল মনসুর, পিতা- মো. শাহ আলম; মো. সোহেল রানা, পিতা- মো. হাবিবুর রহমান বিশ্বাস; হাসানুল বান্না, পিতা- আজাদুল ইসলাম; রেজাউল করিম, পিতা- মো. সুলতান; মো. সালাউদ্দিন, পিতা- মো. আব্দুস সামাদ; মো. রুহুল আমিন, পিতা- মো. সিরাজুল ইসলাম; মো. আরিফুল ইসলাম, পিতা- মো. শামছুল হক; ইউনুছ আলী, পিতা- মতিয়ার রহমান; মো. মনিরুল ইসলাম মনি, পিতা- মো. আশরাফ প্রামানিক এবং মো. জীবন আলী, পিতা- মো. হাফেজ আলী। বিশেষ সংস্থার প্রতিবেদনে মন্তব্য কলামে প্রত্যেকের নামের পাশে নাম ও পিতার নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, প্রদত্ত স্থায়ী ঠিকানায় তাদের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় জালিয়াতি: নিয়োগপ্রাপ্ত ৩৮ জনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়া ১৩ জন জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন। এ তালিকায় রয়েছেন- মো. সাইফুল ইসলাম, পিতা- মো. নূরুল ইসলাম; মো. রুবেল মিয়া, পিতা- ওয়াদুদ মিয়া; মো. শাহীন আলী, পিতা- মো. শরিফুল হক; মো. শামসুজ্জামান, পিতা- মো. আবুল কালাম আজাদ; ইমরান আলী, পিতা- মো. আবু সুফিয়ান; মো. ওমর ফারুক, পিতা- আবদুল জব্বার; মো. কামরুজ্জামান, পিতা- মো. আবদুল কাদের এবং মো. মোমিন হোসেন, পিতা- মো. আনোয়ার হোসেন। তাদের সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তির পিতা মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করলেও তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন।
ময়মনসিংহ জেলার মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগে যেসব অপকর্ম: ময়মনসিংহ জেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ছয়জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজনকে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কারারক্ষী তালিকায় আছেন- মো. আতিকুর রহমান, পিতা- মো. আবু তাহের, নাজনীন আক্তার শীলা, পিতা মো. আবু তাহের এবং মো. হাবিবুর রহমান, পিতা- মো. আজহার আলী। তাদের সম্পর্কে বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মো. আতিকুর রহমান, পিতা- মো. আবু তাহের ৭/৮ বছর আগে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করে অদ্যাবধি কর্মরত রয়েছেন। ওই আতিকুর রহমানের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র ও তার পিতা আবু তাহেরের মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে অপর এক ব্যক্তি ভুয়া আতিকুর রহমান সেজে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কারারক্ষী পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তদন্তে জানা গেছে, অবৈধ সুবিধা নিয়ে পুলিশ সদস্য মো. আতিকুর রহমান তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ এবং পিতা মো. আবু তাহেরের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে অন্য এক ব্যক্তিকে আতিকুর রহমান সাজিয়ে অবৈধভাবে কারারক্ষী পদে চাকরির সহযোগিতা করছেন। এতে বলা হয়, পুলিশ সদস্য মো. আতিকুর রহমানের আপন বোন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নাহিদা আক্তার। নাজনীন আক্তার সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাজনীন আক্তার শীলা, পিতা- মো. আবু তাহের, সহকারী শিক্ষক পদে হায়রনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুক্তাগাছায় কর্মরত আছেন। উক্ত নাজনীন আক্তার এর শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র ও তার পিতা মো. আবু তাহের এর মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে অপর এক নারী প্রার্থীকে ভুয়া নাজনীন আক্তার সেজে অবৈধভাবে কারারক্ষী পদে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নাহিদ আক্তার অন্যান্য দালালের মাধ্যমে পিতা মো. আবু তাহেরের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও বোন নাজনীন আক্তারের সনদপত্র ব্যবহার করে জালিয়াতির মূল পরিকল্পনা করেছেন। প্রতিবেদনে মো. হাবিবুর রহমান সম্পর্কে বলা হয়েছে, মো. হাবিবুর রহমান, পিতা- মো. আজহার আলী’র খোঁজ পাওয়া গেলেও ওই ব্যক্তির নিকট মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় দলিলাদি চাওয়া হলে অজ্ঞাত কারণে তিনি আর যোগাযোগ করেননি। তবে লোক মারফত সে যেসব কাগজপত্র সরবরাহ করে সেগুলো যাচাইকালে দেখা যায়, তার পিতার জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি মুছে ফেলা হয়েছে। তার নিজের ছবি ও জাতীয় পরিচয় পত্র চাওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে সে তা সরবরাহ করেনি। এ ছাড়া তার মুক্তিযোদ্ধা সনদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যয়ন, ইউনিয়ন/উপজেলা/জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদেরও প্রত্যয়নপত্রও সরবরাহ করেনি। তার সঙ্গে কথোপকথনে তাকে ময়মনসিংহ জেলার অধিবাসী বলে প্রতীয়মান হয়নি।
ময়মনসিংহ জেলায় এতিম কোটায় জালিয়াতি: ময়মনসিংহ জেলা থেকে এতিম কোটায় তিনজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনকেই জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ তালিকায় আছেন- আপতার হোসেন বাধন, পিতা- ফজলুল হক; মামুনুর রশিদ, পিতা- চান মিয়া এবং সাদ্দাম হোসেন, পিতা- মো. নজরুল ইসলাম। আপতার হোসেন বাধন সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতিম কোটায় চাকরি পাওয়ার জন্য চাকরির প্রতিপালন ফর্মে তার পিতা ফজলুল হককে মৃত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় তদন্তে আপতার হোসেনের পিতাকে জীবিত পাওয়া যায়। এ ছাড়া এতিম কোটায় চাকরি নেয়ার ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে সরবরাহকৃত কাগজপত্রের সত্যায়িত কপি ভুয়া হিসেবে প্রমাণ হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ- পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম অবৈধ আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে বাধনের এতিম হওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে মিথ্যা সত্যয়নপত্র দিয়েছেন। নিয়োগ পাওয়া মামুনুর রশীদ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মামুনুর রশিদ, পিতা- চান মিয়া নামে কোনো ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়নি।
সাধারণ কোটায় যেসব অনিয়ম: ময়মনসিংহ জেলা থেকে সাধারণ কোটায় ১৪ জনকে কারারক্ষী পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে চারজনকে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ তালিকায় আছেন- মো. আবদুল আজিজ, পিতা- মো. ছিদ্দিকুর রহমান; মো. শফিকুল ইসলাম, পিতা- সাইদুল ইসলাম; নূর মোহাম্মদ, পিতা- মৃত আফজাল হোসেন এবং মো. নাজমুল হক, পিতা- মো. রমজান আলী। তাদের সম্পর্কে বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চারজন প্রার্থীর সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় অনুসন্ধানকালে কাউকে শনাক্ত করা যায়নি। স্থানীয় ব্যক্তিরা ওই সব প্রার্থীদের চিনেন না।
বিশেষ প্রতিবেদনে যেসব মন্তব্য ও সুপারিশ: ময়মনসিংহ জেলার তিন কোটায় কারারক্ষী পদে চাকরিতে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব দুর্নীতিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সহকারী শিক্ষক নাহিদা আক্তার, তার ভাই ও পুলিশ সদস্য মো. আতিকুর রহমান, বোন মুক্তাগাছা উপজেলার হায়দরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নাজনীন আক্তারসহ একটি শক্তিশালী দালালচক্র জড়িত। একই জেলায় এতিম কোটায় চাকরির প্রত্যয়নপত্র দিতে ময়মনসিংহ জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম এবং ফুলবাড়িয়া উপজেলার ইসলামনগর সিদ্দিকীয়া এতিমখানা দারুল হাবিব ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মো. আশরাফ আলী সিদ্দিকী অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি এতিম কোটায় চাকরি পাওয়া কারারক্ষীদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে দালালচক্রকে চিহ্নিত করার সুপারিশ করা হয়েছে বিশেষ প্রতিবেদনে। মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতকারীর সনদ বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন জেলা থেকে যেসব কারারক্ষী অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে যারা চাকরি পেয়েছেন তাদের চাকরিচ্যুতির সুপারিশ করে বলা হয়েছে, দেশে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিযবুত তাহরীরসহ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা রয়েছে। জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতিমধ্যে অনেক জঙ্গিকে আটক করেছে। যারা দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক রয়েছে। এ ছাড়া শীর্ষ সন্ত্রাসী, যুদ্ধাপরাধীসহ কুখ্যাত অপরাধীরা দেশের বিভিন্ন কারাগারে বিচারাধীন অবস্থা শেষে আটক রয়েছে। মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তরা অর্থের জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠবেন। ফলে অর্থের জন্য যে কোনো ধরনের অপরাধ করতে বা অপরাধীকে সাহায্য করতে তারা দ্বিধা করবে না। এ কারণে নৈতিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে কারাগারে আটক অপরাধীরা কারারক্ষীদের ব্যবহার করে দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাতে পারে।