ব্যাংকে ব্যাংকে ঋণের দালাল

Slider অর্থ ও বাণিজ্য
lid-pic_206801
ঋণ দেবে ব্যাংক। সব ব্যবস্থা করে দেবে ঋণের মধ্যস্থতার জন্য গড়ে ওঠা দালাল চক্র। ব্যাংক নির্বাচন, ঋণ আবেদন, ডকুমেন্ট প্রস্তুতসহ সব ঠিক করে দেবে তারা। এ জন্য ‘কনসালট্যান্সি’ ফি হিসেবে ঋণের ৩ থেকে ৭ শতাংশ নগদ কমিশন দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণীর কর্মকর্তার যোগসাজশে এভাবে গড়ে উঠেছে দালাল চক্র। সংঘবদ্ধ এ চক্রের খোঁজ মিলেছে সমকালের অনুসন্ধানে। গ্রাহক সেজে এ ধরনের কয়েকটি গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগের সময় সবাই ঋণ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরিচয় জানার পর প্রত্যেকে অন্য সুরে কথা বলেন। বড় অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে ব্যাংক থেকে বিতরণ হওয়া এসব ঋণ আদায় হবে কি-না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এভাবে ঋণ বিতরণকে ফৌজদারি অপরাধ মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী সমকালকে বলেন, ব্যাংক এবং গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে কাকে ঋণ দেওয়া হবে, তা ব্যাংকই ঠিক করবে। এখানে ‘মধ্যস্থতা’র কোনো সুযোগ ব্যাংকিং নিয়মে নেই। এ ধরনের কাজ কেউ করে থাকলে তা অবশ্যই বেআইনি। তিনি বলেন, যদি এমন হয় যে কেউ একটি পার্টি এনে ব্যাংক থেকে ১০ কোটি টাকার ঋণ পাইয়ে দিয়ে এক কোটি টাকা নিজে নিল আর ব্যাংকার এক কোটি টাকা নিল, তাহলে তা অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ।

সমকাল প্রতিবেদক গ্রাহক সেজে ‘টিসিবিসি’ নামে তথাকথিত কনসালট্যান্সি ফার্মের জনৈক শাহিনুর রহমানের সঙ্গে গত ৫ এপ্রিল যোগাযোগ করেন। প্রথমে তিনি জানতে চান, নম্বরটা কোথায় পেলেন? এর পর কী কাজের জন্য, কত টাকা নিতে আগ্রহী, তা জানতে চান। ছোট একটি পোলট্রি খামারের জন্য সাত লাখ টাকা ঋণের আগ্রহ দেখালে তিনি বলেন, ‘ফোন করেছেন, এ জন্য ধন্যবাদ। তবে এত ছোট ঋণের জন্য আমরা কাজ করি না। আপনাকে বোঝানোর স্বার্থে বলি, আমাদের সঙ্গে ব্যাংকের বড় পর্যায়ের লোক রয়েছে। কোনো কাজে ২০-২৫ লাখ টাকা না পাওয়া গেলে আমাদের পোষায় না।’ বড় কোনো ঋণের বিষয় থাকলে তিনি যোগাযোগ করতে বলেন। এ চক্রের সঙ্গে এনসিসি ব্যাংক ভবন শাখার বড় কর্মকর্তাসহ কয়েকজন ব্যাংকার জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত ১০ এপ্রিল ভিন্ন ফোন নম্বর দিয়ে আবার শাহিনুরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। নোমান গ্রুপের জিএম (আমদানি) মোস্তফা কামাল তার নম্বর দিয়েছেন- এ কথা বলার পর বলেন, ‘আচ্ছা বলুন, কত টাকা ঋণের প্রয়োজন।’ এবার একটু বাড়িয়ে দুই কোটি টাকা ঋণের কথা বললে ওই দিনই তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। শাহিনুরের কথামতো মতিঝিলে এনসিসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে এ প্রতিবেদক দেখা করলে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় এনসিসি ব্যাংক ভবন শাখার ডেপুটি ম্যানেজার মো. ওয়ালিউল ইসলামের কাছে। ভেতরে গিয়ে শাহিনুর এ প্রতিবেদককে দেখিয়ে বলেন, ‘মোস্তফা স্যার পাঠিয়েছেন।’ এ প্রতিবেদকের কাছ থেকে ওয়ালিউল কিছু তথ্য জেনে এর পর বলেন, ‘আমাদের ব্যাংক এ ঋণ দেবে না। তবে কোথা থেকে নিয়ে দেওয়া যায়, দেখি। তা ছাড়া বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকের ভেতরে বেশি আলাপ করা যাবে না।’ পরে যোগাযোগ করে তাদের লালমাটিয়ার অফিসে কথা বলবেন বলে জানান। ব্যাংক থেকে বেরিয়ে শাহিনুর বলেন, ‘আপনি ঋণ পেয়ে যাবেন। তবে হয়তো দু-চার দিন দেরি হবে।’ ঋণ অনুমোদন করিয়ে দিলে কত টাকা তাদের দিতে হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘খরচ-খরচা বাবদ সাধারণত ৫ থেকে ৭ শতাংশ নেওয়া হয়। তবে আলোচনার ভিত্তিতে সেটা কমবেশি হতে পারে।’ জানা গেছে, মাঠ পর্যায় থেকে গ্রাহক সংগ্রহের কাজ করেন প্যারাডে ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কমার্শিয়াল ম্যানেজার শাহিনুর। আর ঋণের মধ্যস্থতার কাজ করেন বড় মাপের ব্যাংকার।

শনিবার আবার ওয়ালিউল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, ঋণ পাইয়ে দিতে আমরা সাহায্য করি। আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন ব্যাংকার ও প্রকৌশলী কাজ করেন।’ তবে সমকালের সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভোল পাল্টে ফেলে বলেন, ‘আমরা ও রকমভাবে ঋণের মধ্যস্থতা করি না। যেহেতু অনেকেই ঋণের প্রস্তাব কীভাবে তৈরি করতে হয় জানে না, এ কারণে প্রোফাইল তৈরি করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা থেকে একটি প্রতিষ্ঠান করেছিলাম।’ ব্যাংকার হিসেবে এমনটি করতে পারেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, টিসিবিসির মাধ্যমে এখনও কোনো কাজ হয়নি। অথচ গত ১০ এপ্রিল গ্রাহক সেজে তার কাছে যাওয়ার পর এ প্রতিবেদককে দুই কোটি টাকার ঋণ করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে একটি ঋণের ‘কনসালট্যান্সি ফার্ম’ খুলেছেন। নিজেদের স্ত্রী বা নিকটাত্মীয়ের নাম ব্যবহার করে খোলা এ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পেতে সহায়তা করা হয়। এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন উপপরিচালকের জড়িত থাকার তথ্য জানার পর তার সঙ্গে গ্রাহক সেজে যোগাযোগ করা হয়। নম্বরটি কে দিয়েছে- এ বিষয়ে জানার পর তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা একটা গ্রুপ খুলেছিলাম। তবে এ মুহূর্তে আমাদের কাজ বন্ধ। আমি সেখানে প্রোফাইল তৈরির কাজ করতাম। প্রোফাইল তৈরির বিষয়ে কোনো কাজ থাকলে সে বিষয়ে আমার সহযোগিতা নিতে পারেন।’ তিন দিন পর আবার যোগাযোগ করে দুই কোটি টাকা ঋণের প্রোফাইল তৈরি করতে কেমন খরচ হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতি কোটিতে তাকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে। তবে ঋণের পরিমাণ বেশি হলে তুলনামূলক খরচ কম নেওয়া হয়। গত শনিবার আবার যোগাযোগ করলে বলেন, ঋণের কনসালট্যান্সির জন্য খোলা প্রতিষ্ঠানটি অভ্যন্তরীণ কিছু ঝামেলার কারণে আপাতত বন্ধ আছে। তবে সমকালের পরিচয় দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি এমনটি করতে পারেন কি-না জানতে চাইলে বলেন, সেবা দেওয়ার জন্য আমরা একটি প্রতিষ্ঠান খুলেছিলাম। তবে সেখান থেকে কোনো কাজ করা হয়নি।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে ‘পুষ্পধারা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের একেবারে পাশে সেনাকল্যাণ ভবনের নিচতলায় অফিস নিয়ে সেখানে ঋণের মধ্যস্থতা, হাউজিং ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজ করা হয়। এ ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে কাজে লাগানো হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করা কর্মচারীদের। দু-চারজন কর্মকর্তার বেআইনি এমন কাজের জন্য বিভিন্ন সময় দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তাদের নানা বদনামে পড়তে হয় বলে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

‘বিজি লাইফ ইজি ব্যাংকিং সলিউশন’ স্লোগানে গড়ে উঠেছে ‘ব্যাংককমপেয়ারবিডি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এর প্রধান নির্বাহী ও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম রয়েছে এম এ মারুফ তৌফিক নামের এক ব্যক্তির। প্রতিষ্ঠানটি ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইট খুলে গ্রাহক থেকে সরাসরি ঋণের আবেদন নিচ্ছে। ফেসবুক পোস্ট ও ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য দেখলে যে কারোরই মনে হবে, প্রতিষ্ঠানটিই ঋণ দেয়। তাদের ওয়েব ঠিকানায় গৃহ, গাড়ি ও ব্যক্তিগত ঋণের জন্য ব্যাংকের নাম দিয়ে পাশে আবেদন ফরম দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই ব্যবসায়িক ঋণ চালু করা হবে বলে ফেসবুক পেজের একাধিক পোস্টের মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ওয়েব ঠিকানায় বিভিন্ন ব্যাংকের নামের পাশে নির্দিষ্ট ঋণের পরিমাণ উল্লেখ করে সুদহার, মাসিক কিস্তি, সুদসহ মোট পরিশোধের পরিমাণ দেওয়া আছে। প্রতিষ্ঠানটির ফরমে এ প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে গত ২১ মার্চ তিন লাখ ও ২ এপ্রিল পাঁচ লাখ টাকা ঋণের জন্য আবেদন করা হয়। নিজের নাম-পরিচয় গোপন করে আবেদনটি জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানানো হয়, শিগগিরই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যোগাযোগ না করায় এ প্রতিবেদক ওয়েব ঠিকানায় দেওয়া ০১৯৪২-৪২৪১১৫ নম্বরে ফোন করলে জানানো হয়, ছোট ঋণের জন্য তারা কাজ করেন না।

ব্যাংকার না হয়েও গ্রাহক থেকে সরাসরি ঋণ আবেদন নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংককমপেয়ারের প্রধান নির্বাহী এম এ মারুফ তৌফিক সমকালকে বলেন, সরাসরি ঋণের কাজ তারা করেন না। কোন ব্যাংকে কেমন সুদ, গ্রাহকের সুবিধার্থে তা একত্র করে ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়। ওয়েবসাইটে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ আবেদন নেওয়া এবং নাম ও লোগো ব্যবহার করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে আলাদাভাবে অনুমোদন নেওয়াটা জটিল হওয়ায় ঋণের কনসালট্যান্সি ফার্ম খোলার আগে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের এনওসি নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এ নিয়ে কোনো নীতিমালা না থাকায় এনওসি পাননি। তবে উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক একজন এমডিসহ কয়েকজন ব্যাংকার তাদের সঙ্গে রয়েছেন।

সরাসরি ঋণের কাজ করেন না- এম এ মারুফ তৌফিকের এমন বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে সরাসরি ঋণের আবেদন নেওয়া হচ্ছে। ফেসবুক পেজে একাধিক পোস্টে ঋণের জন্য সরাসরি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। একটি পোস্টে বলা হয়েছে, ‘কম ইন্টারেস্টে এবং দ্রুত হোম, কার ও ব্যক্তিগত ঋণ নিতে আজই যোগাযোগ করুন ব্যাংককমপেয়ারবিডি ডটকমে।’ অপর একটি পোস্টে দেওয়া হয়েছে, ‘লোনের জন্য আর ব্যাংকে ঘোরাঘুরি না করে আজই আবেদন করুন আমাদের মাধ্যমে।’ পেজটিতে লাইক সংখ্যা রয়েছে সাড়ে ১১ হাজার। আকর্ষণীয় এসব পোস্টের নিচে অনেকেই ঋণ নেওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য লিখেছেন।

ব্যাংকের নাম ব্যবহার করে এভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান আবেদন নিতে পারে কি-না- জানতে চাইলে এনসিসি ব্যাংকের এমডি গোলাম হাফিজ আহমেদ সমকালকে বলেন, ব্যাংকার-গ্রাহকের মাঝখানে মধ্যস্থতার কোনো সুযোগ নেই। কেউ এ কাজ করলে তা বেআইনি। এমন ঘটনায় কোনো ব্যাংকারের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সমকালকে বলেন, ব্যাংকগুলোর উচ্চ পর্যায়ে সৎ ও দক্ষ লোকের অভাবে ঋণের ক্ষেত্রে একটি মধ্যস্থতাকারী গ্রুপ তৈরি হয়ে গেছে। বিষয়টি ঘাঁটলে দেখা যাবে, অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের লোকেরা মধ্যস্থতাকারী খুঁজে ঋণ দিচ্ছেন। এটি একেবারে অগ্রহণযোগ্য। এভাবে ব্যাংক চলতে পারে না। এমন হতে থাকলে ব্যাংক খাত নষ্ট হয়ে যাবে। পরিস্থিতি উত্তরণে ব্যাংক খাতের উচ্চ পর্যায়ে অন্তত ডিএমডি, এমডি ও চেয়ারম্যান পর্যায়ে সৎ এবং শক্ত লোক বসাতে হবে। – See more at: http://bangla.samakal.net/2016/04/18/206801#sthash.LtO2TbUl.dpuf

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *