ঢাকা: আজ ৩০ চৈত্র ১৪২২। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিনে শুচি হোক ধরা’।
ক্রান্তি মানে কিনারা। সংক্রান্তি মানে এক ক্রান্তি বা এক কিনারা থেকে আরেক কিনারায় যাওয়া। অর্থাৎ ক্রান্তির সঞ্চার বা সাঁতার।
মহাকালের অনাদি ও অশেষের মাঝে ঋতুর বদল করতে করতে সূর্য এবং আরও অনেক গ্রহ-উপগ্রহ-গ্রহাণু ও উল্কার সাঁতরে চলা। চক্রের মতো, চরকার মতো সূর্য সাঁতরে চলে। ঋতুরা ফিরে ফিরে আসে। ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে সময়, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর।
এখানে নতুনও নেই, পুরাতনও নেই। আছে সংক্রান্তি। অর্থাৎ এক কিনারা থেকে আরেক কিনারায় যাওয়ার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
বাংলা বছরের হিসাব চলে সূর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তাই সৌরবছর আমাদের। এখানে সময়ের শেষ বা শুরু বলে কিছু নেই। বারো মাসে বছর। বছরের শেষ মাস চৈত্র। চৈত্রের শেষ দিনটার ‘সংক্রান্তি’ হয় আগামী বছরের সঙ্গে।
উপমহাদেশের সনাতন প্রথা অনুসারী মানুষরা এই দিনটিকে খুবই পূণ্যের দিন বলে মনে করে। সনাতন পঞ্জিকা মতে দিনটিকে গণ্য করা হয় মহাবিষুব সংক্রান্তি।
এছাড়া বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী এই দিনটিকে নানা উৎসবের মাধ্যমে পালন করে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিজু ও বৈসাবি উৎসব। পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগরাছড়ি ও বান্দরবানের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী আবহমানকাল থেকে এ উৎসব পালন করে আসছে।
দিন দিন এর আবেদন সমতলবাসীর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি-বাঙালির সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির বন্ধন আরও দৃঢ় হচ্ছে।
সাধারণত চৈত্র সংক্রান্তিতে মেলা, গাজন ও পূজার আয়োজন করা হয়। কিন্তু এর বাইরে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে জড়িত আছে চৈত্র সংক্রান্তি, যা শুধু উৎসব নয়, এক ধরনের লোকাচার।
নিজের ও প্রকৃতির খোঁজ নেওয়া। এই খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব পড়ে নারীর ওপর। যেটা কৃষিজীবী মানুষের প্রজ্ঞার দারুণ প্রকাশ।
অতীতে চৈত্র সংক্রান্তি মেলা উপলক্ষে গ্রামাঞ্চলের গৃহস্থরা নাতি-নাতনিসহ মেয়ে-জামাইকে সমাদর করে বাড়ি নিয়ে আসতো। গৃহস্থরা সবাইকে নতুন জামা-কাপড় দিতো এবং উন্নতমানের খাওয়া-দাওয়ারও আয়োজন করতো। মেলার কয়েকদিন এভাবে সবাই মিলে আনন্দ উপভোগ করতো তারা।
সভ্যতার সর্বগ্রাসী ছোঁয়ায় আবহমান গ্রামবাংলার সেই আনন্দমুখর পরিবেশ আর আগের মতো নেই। তবে শহরাঞ্চলের নগর সংস্কৃতির আমেজে চৈত্র সংক্রান্তির উৎস এখন সর্বজনীন মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
সনাতন মতে, বাংলা মাসের শেষ দিনে শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পূণ্যের কাজ বলে মনে করা হয়।
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে উদ্বিগ্ন কৃষক কূল নিজেদের বাঁচার তাগিদে বর্ষার আগমন দ্রুত হোক, এই প্রার্থনা জানাতেই চৈত্র মাসজুড়ে উৎসবের মধ্যে সূর্যের কৃপা প্রার্থনা করতো।
তাই চৈত্র সংক্রান্তিতে নানা উপাচারের নৈবেদ্য দিয়ে তাকে তুষ্ট করতো সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
চৈত্র সংক্রান্তিতে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরাও আবহমানকাল থেকে পালন করে আসছে নিজস্ব লোকাচার। প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে মুক্তির জন্য এই চৈত্র সংক্রান্তির দিন নদীর চরে বা খোলা মাঠে সবাই একত্রিত হয়ে বিশেষ নামাজ আদায় করতো তারা।
বাড়ি বাড়ি থেকে নগদ টাকা বা চাল সংগ্রহ করে বড় তালগাছ বা বটগাছের নিচে দুধ, তালের গুড় ও সিদ্ধ চাল দিয়ে শিরনি রান্না করে গ্রাম ও মহল্লার মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হতো। অঞ্চল ভেদে এটিকে বটতলা বা তালতলার শিরনি বলা হতো।
তবে হারাতে হারাতে সব কিছুই যে একেবারে হারিয়ে গেছে, তা নয়। নগর সভ্যতার এ যুগে চৈত্র সংক্রান্তিতে দেশজুড়ে এখন চলছে নানা ধরনের মেলা-উৎসব।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গেলে এখনও চোখে পড়বে হালখাতার জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজানো, লাঠিখেলা, গান, আবৃত্তি, সঙযাত্রা, রায়বেশে নৃত্য, শোভাযাত্রাসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হচ্ছে চৈত্র সংক্রান্তি।
নগর কেন্দ্রিক আয়োজনের মধ্যে নতুন বছরকে বরণের প্রস্তুতির পাশাপাশি বছরের শেষ দিনটিতে থাকে বর্ষবিদায়ের নানা আয়োজন।
চৈত্র সংক্রান্তিতে পুরান ঢাকায় ওঝা সেজে হাতে ঝাড়ু নিয়ে বিশেষ ভঙ্গিমায় ছোট শিশুরা ভূত তাড়ানোর খেলায় মেতে ওঠে। এবারও থাকছে সে আয়োজন।
দেশের হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে চৈত্র সংক্রান্তির নানা উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে বারোয়ারি মেলা অন্যতম। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, দিনাজপুরের ফুলছড়িঘাট এলাকা, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট ও ঢাকার সাভার, ধামরাইয়ে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা বসে। এবারও এসব অঞ্চলে বসছে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা।
চৈত্র সংক্রান্তির দিন সন্ন্যাসী বা সাধারণ লোকদের মধ্যে কাউকে কাউকে শূলফোঁড়া, বাণফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে চড়ে ‘ভয়ঙ্কর’ দৈহিক কলাকৌশল করতে দেখা যায়।
ঢাকার ধামরাইয়ে এখনও এটা নজরে পড়ে। পূণ্য লাভের আশায় আদিম এবং অবৈজ্ঞানিক এই শারিরীক কসরত অবশ্য দিন দিন কমে আসছে।
আমাদের লোকজ সংস্কৃতির যা কিছু সত্য, সুন্দর, শুভ ও শুচি তা টিকে থাকুক অনন্তকাল-এই হোক চৈত্র সংক্রান্তির প্রার্থনা। জয়তু চৈত্র সংক্রান্তি-১৪২২।