বিদ্যুৎ উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়লেও সমস্যা রয়েছে বিতরণ ব্যবস্থায়। বিদ্যুৎ সঞ্চালন এবং বিতরণ লাইন সম্প্রসারণ ও সংস্কার যেভাবে হওয়া প্রয়োজন ছিল, বাস্তবে তাতে ঘাটতি রয়েছে। এ জন্য বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রাহকের কাছে পেঁৗছানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রচণ্ড গরমে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। দুর্ভোগ হচ্ছে গ্রাহকদের। বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনের বহু সাবস্টেশনের ওপর বাড়তি চাপ রয়েছে। নির্দিষ্ট এলাকার চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ থাকা সত্ত্বেও তা সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতে সারাদেশে বহু স্থানে জরাজীর্ণ খাম্বা উপড়ে পড়ছে। ট্রান্সফরমার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে দুর্ভোগ বাড়ছে গ্রাহকদের। সামনে ঝড়-বৃষ্টির মৌসুম। এ সময়ে গ্রাহকদের দুর্ভোগ আরও বাড়তে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
কয়েক বছর আগেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি ছিল। এখন তেমন ঘাটতি নেই। বরং গ্যাসের অভাবে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। গত রোববার উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হয় ৮ হাজার ৩৪৩ মেগাওয়াট।
সামান্য ঝড়ে বিতরণ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এরই মধ্যে একদিন বরিশাল শহরে অন্ধকার নেমে আসে। কয়েক দিন আগে উত্তরাঞ্চলের ৮টি জেলাও একই কারণে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। গ্রামাঞ্চলে এই গরমে প্রতিদিন তিন-চারবার করে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে গ্রাহকরা অকপটে স্বীকার করছেন, আগের তুলনায় বিদ্যুতের দুর্ভোগ অনেক কমেছে।
বিতরণে এই দুরবস্থার কথা অবশ্য অস্বীকার করেনি বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, উৎপাদন পর্যাপ্ত পরিমাণে বাড়লেও বিতরণ খাতে এখনও সমস্যা রয়েছে। ফলে বিভিন্ন স্থানে মাঝে-মধ্যে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে আরও তিন বছর সময় লাগবে বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে সরকার পর্যাপ্ত প্রকল্প নিয়েছে। তাড়াতাড়িই এ সমস্যা সমাধান হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিদ্যুৎ সুবিধা পেত ৪৭ ভাগ জনগণ। এখন পাচ্ছে ৭৫ ভাগ। বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা শতাধিক। এ ছাড়া ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে। ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা (ক্যাপটিভসহ) ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। বেড়েছে আট হাজার ৯৪১ মেগাওয়াট। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট। আর চলতি বছর গত ৯ এপ্রিল সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে ৮ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট।
২০০৯ সালে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা, বর্তমানে ৩৭১ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বেড়েছে ১৫১ কিলোওয়াট ঘণ্টা। বিদ্যুৎ গ্রাহক ছিল এক কোটি আট লাখ, বর্তমানে প্রায় দুই কোটি। ২০০৯ সালে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল দুুই হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা, চলতি বাজেটে বরাদ্দ ১৬ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ খাতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জানান, বিগত বছরগুলোতে উৎপাদন খাতে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে ততটা দেওয়া হয়নি। গত সাত বছরে বিদ্যুৎ খাতে আট বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে, যার সিংহভাগ ব্যয় হয়েছে উৎপাদন খাতে। এখন বিতরণ খাত উন্নয়নে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
মহাজোট সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে (২০০৯ থেকে ২০১৪) দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৬২ শতাংশ বাড়লেও সঞ্চালন লাইন বেড়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ। আর বিতরণ লাইন বেড়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। পরের মেয়াদে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বারোপ করে। বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। সেগুলোর কাজ চলছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যুতের উৎপাদন যে গতিতে বাড়ছে সে গতিতে যদি সরবরাহ অবকাঠামো গড়ে তোলা না হয়, তাহলে জনগণ বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের সুফল পাবে না।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ চলে গেলেই সাধারণ জনগণ মনে করেন বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে লোডশেডিং হচ্ছে, তা ঠিক নয়। এটা লোডশেডিং নয়, বিদ্যুৎ বিভ্রাট। বিতরণ লাইনে ত্রুটির কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন পর্যাপ্ত পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে চাহিদা মেটানোর মতো সক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে ২ কোটি গ্রাহকের যে চাহিদা তা পূরণ করার মতো উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে।
দেশে বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থা বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত। গত সাত বছরে এ খাতে কর্মকাণ্ডের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হলো :
পিডিবি: বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) একাধারে উৎপাদন ও বিতরণের দায়িত্ব পালন করে থাকে। দেশের বড় বড় শহরে বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে পিডিবি। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে পিডিবির বিতরণ লাইন ছিল ২৯ হাজার ৫৮৯ কিলোমিটার, যা ২০১৪-১৫ বছরে বেড়ে হয় ৪০ হাজার ৬০৩ কিলোমিটার। অর্থাৎ গত সাত বছরে পিডিবির বিতরণ লাইন বেড়েছে মাত্র ১১ হাজার কিলোমিটার। কিন্তু সে তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে অনেক বেশি। যে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের সীমাবদ্ধতার কারণে গ্রাহকের দ্বারপ্রান্তে পেঁৗছানো যাচ্ছে না।
ডিপিডিসি: রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশ এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। ডিপিডিসি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে ডিপিডিসির বিতরণ লাইন ছিল তিন হাজার ৮৫৪ কিলোমিটার, যা ২০১৪-১৫ বছরে বেড়ে হয় চার হাজার ৮৩০ কিলোমিটার। অর্থাৎ গত চার বছরে বেড়েছে মাত্র ৯৭৬ কিলোমিটার। কিন্তু ঢাকায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে বছরপ্রতি ১০ ভাগের বেশি করে।
ডেসকো: গুলশান, মিরপুর, টঙ্গীসহ ঢাকার একাংশে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে ডেসকোর বিতরণ লাইন ছিল ৩ হাজার ১৩৭ কিলোমিটার। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে, তাদের বিতরণ লাইন ৪ হাজার ১৮৬ কিলোমিটার। অর্থাৎ বিতরণ লাইন বেড়েছে মাত্র এক হাজার ৪৩ কিলোমিটার। ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশন ২০০৯ সালে ছিল ২১টি, ২০১৫ সালের শেষে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩১টি। বেড়েছে মাত্র ১০টি। বিতরণ ট্রান্সফরমার ২০০৯-এ ছিল চার হাজার ৫৬৩টি, যা ২০১৬ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৬ হাজার ১৫১টি। বিগত ৬ বছরে ১৩২/৩৩ কেভির দুটি সাবস্টেশন নির্মাণ করে ডেসকো। সরবরাহ লাইনের তুলনায় ডেসকোর এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে অনেক বেশি।
আরইবি: বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সারাদেশে ছোট শহরসহ গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। সব থেকে বেশি গ্রাহক এ সংস্থার। আরইবি সূত্র জানায়, তাদের ৭ লাখ বিতরণ ট্রান্সফরমারের মধ্যে ১ লাখের বেশি ওভারলোডেড। অর্থাৎ ওই ট্রান্সফরমারের আওতায় বিদ্যুতের যে চাহিদা তৈরি হয়েছে তা বিতরণ করার ক্ষমতা ওই ট্রান্সফরমারের নেই। অবশ্য আশার খবর হলো, এর মধ্যে ৭০ হাজার ট্রান্সফরমার প্রতিস্থাপনের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে আরইবির বিতরণ লাইন ছিল ২ লাখ ১৬ কিলোমিটার। বর্তমানে ২ লাখ ৯৯ হাজার কিলোমিটার।
ওজোপাডিকো: পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। ২০১০ সালে ৩৩/১১ কেভির সাবস্টেশন ছিল ৬১টি, পরের ৫ বছরে মাত্র দুটি সাবস্টেশন বেড়েছে। ২০১০ সালে ৩৩ কেভির লাইন ছিল এক হাজার ৫৭৩ কিলোমিটার। পরের পাঁচ বছরে বেড়েছে মাত্র ২৯ কিলোমিটার। ১১ ও দশমিক ৪ কেভির লাইন ২০১০-এ ছিল আট হাজার ১১৫ কিলোমিটার। যা পরের ৫ বছরে বেড়ে হয়েছে আট হাজার ৯২৪ কিলোমিটার। ৩৩ কেভি বিতরণ ট্রান্সফরমার ছিল ৬৬টি, পরে কমে গিয়ে ২০১৪ সালে হয় ৪০টি। ১১ কেভির ট্রান্সফরমার ২০১০-এ ছিল চার হাজার ৬৯১টি, পরের ৫ বছরে বেড়ে হয় ৫ হাজার ৪১৭টি। এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণে ব্যাপক সমস্যা রয়েছে বলে জানা যায়। ফলে পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পরিমাণ বেশি।
পিজিসিবি: সারাদেশে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে নিয়োজিত পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন ছিল ২ হাজার ৬৪৫ কিলোমিটার, ১৩২ কেভি ছিল ৫ হাজার ৬০৮ কিলোমিটার। ২৩০/১৩২ কেভি সাবস্টেশন (বিদ্যুৎ সরবরাহ উপকেন্দ্র) ১২টি (৬০৭৫ এমভিএ)। ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন ছিল ৭১টি (৭৩৯৯ এমভিএ)। পিজিসিবির দেওয়া ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায়, বর্তমানে ৪০০ কেভি লাইন নির্মাণ করা হয়েছে ২২১ কিলোমিটার। ৪০০ কেভির লাইন আগে ছিল না। ২৩০ কেভি লাইনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৭১ কিলোমিটার। ১৩২ কেভি লাইনের পরিমাণ হলো ৬ হাজার ৩৯৭ কিলোমিটার। এইচভিডিসি স্টেশন একটি (৫০০ মেগাওয়াট)। ৪০০/২৩০ কেভি সাবস্টেশন একটি (৫২০ এমভিএ)। ২৩০/১৩২ কেভি সাবস্টেশন ২১টি (৯৯২৫ এমভিএ)। আর ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন ১১১টি (১৪ হাজার ৮৭৮ এমভিএ)।