আমেরিকা তাদের কাছে ছিল স্বপ্নের দেশ। শুনেছিলেন, যে কোনো উপায়ে একবার সেখানে পৌঁছলেই পাল্টে যাবে জীবনমান। সপরিবারে বাসিন্দা হয়ে যাবেন দেশটির। এজন্য সহায়-সম্বল বিক্রি করে পাড়ি জমিয়েছিলেন। দিনের পর দিন অপরিসীম দুর্ভোগ সহ্য করেছেন। আর অবৈধভাবে দেশটিতে যেতেও খরচ করতে হয়েছে কাঁড়িকাঁড়ি টাকা। শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন স্বপ্নের দেশে। কিন্তু ঠাঁই হয়নি সেখানে। জীবনমান পাল্টানোর যে স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিলেন, ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। প্রায় দেড় বছর পর ফিরে এসেছেন শূন্য হাতে। ফিরেছেন দাগি আসামির মতো। দেশের ফেরার আগ পর্যন্ত ছিল হাত-পা বাঁধা। একে একে বাঁধন খুলে দিয়ে বিমান থেকে নামানো হয়েছে বিমানবন্দরে। অবৈধভাবে আমেরিকায় যাওয়া ২৭ বাংলাদেশি বুধবার রাত ১টায় দেশে ফেরেন। মিয়ামী ইন্টারন্যাশনালের একটি বিশেষ ফ্লাইট তাদেরকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়। বিমানবন্দরে তাদের অনেককেই কাঁদতে দেখা যায়। এই বাংলাদেশিরা এতটাই অসহায় হয়ে ফিরেছেন যে ঢাকা থেকে স্বজনের কাছে পৌঁছানোর খরচটুকুও ছিল না তাদের কাছে। এমনকি তারা যে দেশে ফিরে এসেছেন তাও জানে না স্বজনরা। ‘ভালোবাসি বাংলাদেশ’ নামে একটি এনজিও তাদের হালকা খাবার-পানীয় এবং বাড়িতে যাওয়ার ভাড়া সরবরাহ করে। তাই নিয়েই রওনা হন বাড়ির উদ্দেশ্যে। বুধবার গভীর রাতে তারা বিমানবন্দরে নেমে ভয়াবহ নানা অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন। অন্যদিকে আমেরিকা যাত্রার স্বপ্ন দেখে বিশাল এক আন্তর্জাতিক দালালচক্রের ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমেরিকা থেকে এভাবে ফেরত আসার ঘটনা এটাই প্রথম। এই ২৭ জনের একজন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি থানার কামাল হোসেন। তিনি অবৈধভাবে আমেরিকা প্রবেশ করে তিন মাস জেলবাস করে দেশে ফিরেছেন। তিনি টেক্সাস সীমান্ত দিয়ে দেশটিতে ঢুকেছিলেন। কামাল জানান, অবৈধভাবে আমেরিকা যাওয়ার জন্য ১২ লাখ টাকা দেন সোনাইমুড়ি উপজেলার ৯নং ইউনিয়নের এক ব্যক্তির কাছে। ওই ব্যক্তি তার মুখচেনা। তিনি জানান, ২০১৪ সালের ১লা আগস্ট টুরিস্ট ভিসা নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বলিভিয়া যান। সেখান থেকে সড়কপথে ব্রাজিল পাড়ি দেন। এ সময় তাকে সহযোগিতা করেছিল ঢাকার কেরানীগঞ্জের এক দালাল। ওই দালালকে দেন ৮ লাখ টাকা। এভাবে ভেনিজুয়েলা হয়ে মোট ২১টি দেশ পাড়ি দিয়ে আমেরিকা পৌঁছান। আর প্রত্যেক দেশের সীমানা অতিক্রম করতে তাকে দালালের সহযোগিতা নিতে হয়েছে। বাড়ি থেকেই এই টাকা বিভিন্ন সময় পাঠানো হয়। দেশটিতে পৌঁছানোর পর সেখানে বসবাসের বৈধতা পেতে আইনজীবীকে দিয়েছিলেন ১৪ লাখ টাকা। সব মিলে তার ৪০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। কিন্তু এই খরচ করেও তিনি শেষ রক্ষা পাননি। অবৈধ প্রবেশের দায়ে তাকে ১৭ মাস জেলে কাটাতে হয়েছে। কামালের ভাষ্যমতে, সেখানে তার সঙ্গে আরও ২শ’ জনের মতো বাংলাদেশি জেলবাস করছিলেন। তিনি বলেন, তার এলাকার ফয়েজ উদ্দিন একইভাবে আমেরিকা গেছেন জানার পর তিনিও সেই দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেই ফয়েজও শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গেই ফেরত এসেছেন। সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার দুবাগ উত্তর গ্রামের আবদুল মালিকের ছেলে ৩০ বছরের যুবক রাসেল আহমেদ। তার ভাই সৌদি আরব প্রবাসী। ভাইয়ের মাধ্যমে আমেরিকা পাঠানোর দালালের সন্ধান পান। ওই দালালের সঙ্গে তিনি ২০ লাখ টাকায় আমেরিকা পৌঁছানোর চুক্তি করেন। সেই মোতাবেক তাকে ২০ লাখ টাকা দিয়ে ২০১৪ সালের ৪ঠা আগস্ট টুরিস্ট ভিসা নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে পেরু যান। সেখানে ইকবাল নামে এক বাংলাদেশি দালাল তাকে গ্রহণ করে। সে তাদের মেক্সিকান এক দালালের কাছে দিয়ে দেয়। এরপর ওই দালাল তাদের ইকুয়েডর-কলম্বিয়া হয়ে পানামা নিয়ে যায়। পানামা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে টানা চারদিন হাঁটার পর তারা ক্যাম্পে গিয়ে পানামা পুলিশের কাছে ধরা দেন। পুলিশ তাদেরকে দেশটির তিনটি ক্যাম্পে ৬ দিন আটকে রাখে। পরদিন পুলিশের গাড়ি তাদেরকে পানামা সিটির একটি হোটেলে রেখে আসে। সেই হোটেল থেকে নিকারাগুয়ার এক দালাল তাদের গ্রহণ করে এলসালভাদর নিয়ে যায়। এই দেশ থেকে সাগরপথ দিয়ে ৫ ঘণ্টায় গুয়াতিমালায় পৌঁছায়। সেখানে আরেক দালাল তাদের নিয়ে মেক্সিকোতে পৌঁছে দেয়। সেখানে তারা ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে ধরা দেয়। পুলিশ তাদের ২০ দিনের মধ্যে দেশ ছাড়ার আউট পাস দেয়। এই ডকুমেন্ট দিয়ে বিমানে করে তারা মেক্সিকোর সানচিত্র সীমান্তে যান। এরপর সীমান্তে আমেরিকান পুলিশের কাছে ধরা দেন। পুলিশ তাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে ২০১৪ সালের ১৪ই অক্টোবর রিফিউজি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পের কর্মকর্তা তাদের জানায়, তারা আদৌ দেশে থাকতে পারবে কি না তা কোর্ট নির্ধারণ করবে। তাদের ক্যালিফোর্নিয়ার সানদিয়াগো কোর্টে হাজির করে। সেখানে ২০ হাজার ডলার দিয়ে এক আইনজীবীর শরণাপন্ন হন রাসেল। বিচারক তাকে বলেন, তোমার দেশ রিপোর্ট দিয়েছে যে তুমি টেরোরিস্ট। পরে তাকে দেশে পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে বললে তিনি অস্বীকৃতি জানান। পরে ওই ক্যাম্পেই ১১ মাস কাটে তার। ক্যাম্পে অবস্থানের শেষদিকে কর্মকর্তা তার স্পন্সর জোগাড় করতে বলে। তিনি আশ্বাস দেন যে, স্পন্সর পেলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। সেই অনুযায়ী দেশটিতে অবস্থানরত তার এক আত্মীয়ের যাবতীয় ডকুমেন্ট জমা দেন। তাকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলে ২০১৫ সালের ১৯শে নভেম্বর শিকাগো নিয়ে আসে। সেখানে বিমানের সামনে এনে তাকে ধাক্কা দিয়ে দেশে চলে যেতে বলে। কিন্তু তিনি আবারও দেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানান। কান্নাকাটি করেন। পরে তাকে আলবামা নামে শহরের একটি জেলে রাখে। রাসেল জানান, ওই জেলে সব বড় বড় ক্রিমিনাল ছিল। সেখানে তাকে ৪ মাস রাখা হয়। এরমধ্যে ৩ দিন অন্য একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ৪৫ জন বাঙালি ছিল বলে জানান রাসেল। এ বছরের ১৯শে মার্চ তাকে অ্যারিজনা সিটির একটি স্থানে নিয়ে গিয়ে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। এর কয়েকদিন পর আরেক ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে গত ৩রা মার্চ রাত ১০টার দিকে হাত-পা বেঁধেই তাদের এয়ারপোর্টে নিয়ে বিমানে তোলা হয়। ৩ দিন পর সেই অবস্থায়ই তারা শাহজালালে পৌঁছেন। একইসঙ্গে ফিরে আসা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার গোপালপুর গ্রামের মনজুর জানান, তার ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তার এলাকার এক দালালের মাধ্যমে ঢাকার একটি এজেন্সিকে তিনি টাকা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, হাত-পা বেঁধে তাদের বিমানে তুলেছে। একে একে বাঁধন খুলে শাহজালাল বিমানবন্দরে নামিয়েছে। মনজুর ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ-তে পড়তেন। ফিরে আসা বাংলাদেশিদের অভিযোগ, তারা সেখানে কোনো বাংলাদেশি কর্মকর্তার দেখা পাননি। সূত্র জানিয়েছে, এই ২৭ বাংলাদেশি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আমেরিকান দূতাবাসের সহযোগিতায় দেশে ফিরেছেন। এছাড়া তাদের আর কোনো প্রকার সহযোগিতা করা হয়নি। এদিকে এক কাপড়ে ফিরে আসা এসব বাংলাদেশিদের কারোর কাছেই কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। বুধবার তারা বিমানবন্দরে নামার পর ‘ভালোবাসি বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন তাদের হালকা খাবার-পানীয় এবং বাড়ি ফেরার ভাড়া সরবরাহ করে। ফিরে আসা এসব বাংলাদেশিদের মধ্যে রয়েছে মুন্সিগঞ্জের ২ জন, ঢাকার ৪ জন, নোয়াখালীর ১৩ জন, সিলেটের ৮ জন। বিমানবন্দরে আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। ২৭ বাংলাদেশী ফেরত পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল এক ই-মেইল বার্তায় ঢাকাস্থা আমেরিকান সেন্টারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিষয়টি হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দেখে। সকল আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের সকল ধরনের আইনী সুবিধা দেয়া হয়েছে।