গ্রাম বাংলা ডেস্ক: ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১০ বছরআওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ১০ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নতুন তদন্তে বেরিয়ে আসে অনেক অজানা তথ্য। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে এর অধিকতর তদন্তের পর বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করে। বিচার শেষ করতে আরও অন্তত এক বছর লাগতে পারে বলে মনে করছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা।
গত আড়াই বছরে এ-সংক্রান্ত মামলা দুটিতে নতুন করে ৩৮ জনের সাক্ষ্য-জেরা শেষ হয়েছে। বাকি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের সাক্ষ্য নিয়ে বিচারকাজ এখনো চলছে।
রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলার প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মামলার গতি-প্রকৃতি আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই চলছে। তিনি বলেন, এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ মোট ৪৯১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অভিযোগপত্র দেওয়ার পর এবং এবার সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়ার আগ পর্যন্ত ৬১ জনের সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয়েছে। সব মিলে ৯৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে। বাকিদের সবার সাক্ষ্য নেওয়া হবে না। অভিযোগ প্রমাণের জন্য যতজনের প্রয়োজন, কেবল ততজনের সাক্ষ্য নেওয়া হবে। এ জন্য আরও এক বছর লাগতে পারে।
তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের দাবি, এ মামলার বিচারকাজের গতি-প্রকৃতি অনেকাংশেই নির্ভর করছে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে অবস্থিত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর অস্থায়ী এজলাসে মামলার বিচারকাজ চলছে। সপ্তাহে দুই দিন করে শুনানি নেওয়া হচ্ছে।
বারবার তাঁর ওপর হামলা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্যও ছিলেন তিনি। হামলার পরের দিন দুপুরে ধানমন্ডির বাসায় শেখ হাসিনা l ছবি: শামসুল হক২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২২ জন নিহত হন। আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েক শ নেতা-কর্মী। এঁদের অনেকে আজও শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ জীবন যাপন করছেন।
বিএনপি সরকারের সাজানো তদন্ত: হামলার দিনই পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা করে। মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। শুরু থেকেই তদন্তের গতি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে তৎকালীন সরকার। তদন্তের নামে বিষয়টিকে বিতর্কিত করার কাজ শুরু হয় সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ একটি মহলের প্রভাব ছিল বলে শুরু থেকেই অভিযোগ ছিল। পরবর্তীকালে একাধিক তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
ঘটনার গুরুত্ব নষ্ট করতে হামলার শিকার আওয়ামী লীগের দিকেই সন্দেহের আঙুল তুলেছিলেন বিএনপির লোকজন। ওই সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও নেতা তাঁদের বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ নিজেরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রচারণা চালান। হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলেও তখন একটা মহল থেকে প্রচারণা চালানো হয়।
ঘটনা তদন্তে ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনও গঠন করেছিল চারদলীয় জোট সরকার। সেই কমিশনও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অপপ্রচারের পথ ধরেই চলেছিল। এক মাস ১০ দিনের মাথায় কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দিয়ে বলে, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে, এই হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তি বলতে কোনো দেশের নাম বলা হয়নি। তবে ২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন বৃহৎ প্রতিবেশী শক্তি হিসেবে ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করেন।
জজ মিয়া উপাখ্যান: ঘটনার ১০ মাসের মাথায় ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের বাড়ি থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে সিআইডি আটক করে। ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে জজ মিয়ার কাছ থেকে সিআইডি সাজানো জবানবন্দি নেয়।
এই জজ মিয়াকে দিয়েই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে তদন্তের নামে ‘আষাঢ়ে গল্প’ প্রচার করেছিলেন মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি আবদুর রশিদ ও তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন। সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনিও এই সাজানো ছকে কথিত তদন্তকে এগিয়ে নিয়ে যান। এই গল্প সাজানোর ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তাদের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন বলে পরে তদন্তে জানা গেছে।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া সেই সাজানো জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, তিনি আগে কখনো গ্রেনেড দেখেননি; গ্রেনেড ও বোমার মধ্যে পার্থক্য তিনি জানেন না। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। আর বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ। এই সাজানো গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটা। উল্লিখিত সন্ত্রাসীদের বেশির ভাগ চারদলীয় জোট সরকারের সময় ভারতে পালিয়ে যায়।
এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৬ সালের আগস্টে এই নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস করে দেন জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন। প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের পর থেকেই সিআইডি তাঁর পরিবারকে মাসে মাসে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছে। জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলায় রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও ফাঁস করে দেন তিনি। (সূত্র: প্রথম আলো, ২১ আগস্ট ২০০৬)
সত্য উদ্ঘাটনের শুরু তত্ত্বাবধায়ক আমলে: ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে এই মামলার তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তাতে বেরিয়ে আসে, বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর সহযোগিতায় উগ্রপন্থী গোপন সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) জঙ্গিরা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল।
তদন্ত শেষে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবির ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে আদালতে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেন। তাতে হুজি-বির নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। একই সঙ্গে জোট সরকারের আমলে গ্রেপ্তার করা জজ মিয়াসহ ২০ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
অধিকতর তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিআইডি এ মামলার অধিকতর তদন্ত করে এবং ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। তাতে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়। উভয় অভিযোগপত্র মিলে মোট আসামির সংখ্যা ৫২।
২০১২ সালের ১৮ মার্চ হত্যা মামলায় ৫২ জনের বিরুদ্ধে এবং বিস্ফোরক মামলায় ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এর মধ্যে বিস্ফোরক মামলায় সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের সাবেক ১১ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেন আদালত।
সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়ার পর আদালত ২০১২ সালের ১৮ মার্চ মামলা দুটির অভিযোগ গঠন করেন। এর পর থেকে আবার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। দুই আসামির দুই দফা হাইকোর্টে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ছয় মাস বিচারিক আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান অভিযোগ করেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মামলার বিচারকাজ বিলম্ব করতে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে জেরা করে সময় নষ্ট করেছেন।
এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসামিপক্ষের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া পাল্টা অভিযোগ করেন, সরকার মামলা দুটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এ কারণে রাজনৈতিক আসামিরা উচ্চ আদালতেও জামিন পাচ্ছেন না। তিনি আরও অভিযোগ করেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীদের আদালতে যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
আসামিদের মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৯ জন পলাতক এবং পুলিশের সাবেক ছয় কর্মকর্তা ও বিএনপি-সমর্থিত সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুর রহমান জামিনে আছেন। বাবর, পিন্টু, মুজাহিদসহ ২৬ আসামি কারাগারে আছেন।
এদিকে দুই দিন আগে জানা গেছে, পলাতক আসামিদের মধ্যে মাওলানা তাজউদ্দিন দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন। পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল বাংলাদেশ পুলিশকে এ কথা জানিয়েছে।
সম্পূরক অভিযোগপত্রের আসামিরা: তারেক রহমান ছাড়াও লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতের নেতা আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদ, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক সাংসদ কায়কোবাদ, খালেদা জিয়ার ভাগনে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি খান সাইদ হাসান ও মো. ওবায়দুর রহমান, জোট সরকারের আমলে মামলার তিন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও এএসপি আবদুর রশিদকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া হুজির ১০ জন নেতা ও হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফকেও এই মামলায় আসামি করা হয়।