ঢাকা: অনিয়ম সহিংসতা আর সংর্ঘষের মধ্য দিয়ে শেষ হলো প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। দলীয় প্রতীকে প্রথম এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে অন্তত ২১ জন। এর মধ্যে অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত। আহত হয়েছে আরো দুই হাজারের বেশি।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন বারবারই দাবি করছে, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। বিজিবি প্রধানও বলছেন, নিয়ম মেনেই গুলি করেছে তার বাহিনী। ভবিষ্যতে সেরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে আবারো গুলি চলবে।
এদিকে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে ইসি। এ কারণে নির্বাচনে সংর্ঘষ সহিংসতার দায় এড়াতে পারে না তারা। একই সঙ্গে এতগুলো প্রাণ ঝরে যাওয়ার পরও নির্বাচন ‘সুষ্ঠু হয়েছে’ দাবি করা দুঃখজনক।
গত মঙ্গলবার প্রথম ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিশেষ করে পিরোজপুর, কক্সবাজার, নেত্রকোনা ও ঝালকাঠিতে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
তবে এতোকিছুর পরও নির্বাচন কমিশন বলছে এসব কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ৭১২ ইউনিয়ন পরিষদে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে দাবি করছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকীবউদ্দিন আহমদ।
গতকাল বুধবার ইসি সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম তার নিজ কার্যালয়ে বলেন, ভোটার উপস্থিতির চিত্র গণমাধ্যমে দেখে উৎসাহিত হয়েছি। গ্রামাঞ্চলের নির্বাচন হলেও নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। নির্বাচনে গড়ে ৭৩ দশমিক ৮২ শতাংশ ভোট পড়েছে বলেও জানান তিনি।
এমন ব্যক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইউপি নির্বাচনের নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ইউপি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন কোনো ভূমিকাই পালন করেনি, শুধু দায়সারাভাবে কিছু কথা বলে গেছে। এতোগুলো প্রাণহানির জন্য নির্বাচন কমিশন দায়ী। তাদের এই আনুগত্যমূলক, সেবাদাসমূলক আচরণের কারণে এতোগুলো জীবনহানি হলো।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলামেইলকে বলেন, নির্বাচনে মারামারি, হাঙ্গামার চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে স্পষ্ট বলা যায় এ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ইউপি ভোটে অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে। সিলমারা, কেন্দ্র দখল, জবরদস্তি এবং অনিয়মের প্রতিফলন ঘটেছে নির্বাচনী ফলাফলে।এর দ্বায় নির্বাচন কমিশন এড়াতে পারে না।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ডেমোক্রেসি ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক তালেয়া রহমান বলেন, ভোটের আগেই ইসি বলেছে, নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হলে পুলিশ দায়ী হবে। এটা কখনও হতে পারে না। নির্বাচনে প্রসাশন ব্যবস্থা থেকে যা কিছু হয় সব কিছু দায় বর্তায় নির্বাচন কমিশনের ওপর। আমরা খুব দুঃখ পেয়েছি, এতগুলো প্রাণ যাওয়ার পরও ইসি কীভাবে বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে!
তালেয়া রহমান বলেন, ‘নির্বাচন মানুষের রাইট। নির্বাচনে এভাবে নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে অবাধে প্রাণ গেলে অনেক দুশচিন্তার ব্যাপার। একরম হলে মানুষ আর ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবে না। নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এবারেই আশা করেছিলাম সুষ্ঠু নির্বাচনের। নির্বাচনের আগে তারা বেশ কিছু কথা বলেছে। ইসি বলেছে নির্বাচনে অনিয়ম হলে দায়ি হবে পুলিশ নির্বাচন কর্মকর্তা। এখন কিভাবে তাদের দায়ি করবে এটা দেখতে চাচ্ছি।’
‘প্রথম ধাপেই যদি এত প্রাণ ঝরে আরো ৫ ধাপ নির্বাচন বাকি এসবে আরো কত প্রাণ যাবে এ নিয়ে আমরা খুবই দুশচিন্তায় আছি’, যোগ করেন তিনি।
এদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতার বিষয়ে স্থানীয় লোকদের অসহযোগিতাকে দায়ী করে বিজিবির মহাপরিচালক আজিজ আহমেদ বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় লোকজন সহযোগিতা না করায় এ ধরনের ঘটনার অবতারণা হয়েছে। কোনো জায়গায় স্থানীয় লোকজন অসহযোগিতা করলে আর কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তার দায়ভার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর বর্তায় না। নির্বাচনে যারা এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, তাদের ওপর এর দায়ভার বর্তায়। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি পরিস্থিতি বাধ্য করে ভবিষ্যতেও গুলি চালাতে বাধ্য হবে বিজিবি।’
প্রথম ধাপেই এতো প্রাণহানির কারনে বিভিন্ন মহল থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তারপরও নির্বাচন কমিশন দাবি করছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এর ব্যাখ্যা কী জানতে চাইলে ইসি সচিব সিরাজুল ইসলাম বাংলামেইলকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট। কমিশন সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েই নির্বাচন শুরু করেছে। প্রথম ধাপের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করা স্বার্থে কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। আর যেসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে এসব তদন্ত করে দেখতে হবে। এরপর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পরের ধাপগুলোতে এমন সহিংসতা আরো বাড়তে পারে- প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, ‘কোনো আশঙ্কা নেই। আগে থেকে কী হবে, কী হবে না এ নিয়ে কোনো আশঙ্কাই করা যায় না। ভোটারদের জানমাল রক্ষার জন্য কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবো। কেউ নির্বাচনে অনিয়ম করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা মোকাবেলা করবে।তারা কোনো অনিয়ম করলে আমরা ব্যবস্থা নিবো।’
গত মঙ্গলবার ৭১২ ইউপিতে ভোটগ্রহণ হয়। বৃহস্পতিবার ইসি ৬২৯টি ইউপির ফল জানিয়েছে। ৫২৯ ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগ ৪৬৯, বিএনপি ৪৯, জাতীয় পার্টি- জেপি ৭, ওয়ার্কার্স পার্টি ২, জাতীয় পার্টি ২, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ৩, ইসলামী আন্দোলন ১ ও স্বতন্ত্র ১০৭টিতে জয় পেয়েছে।