ঢাকা: জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর রায় নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় ফেঁসে গেছেন দুই মন্ত্রী। রোববার উচ্চ আদালতে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে আদালত তা গ্রহণ করেননি। উল্টো দু’জনকেই এবং তাদের আইনজীবীদ্বয়কে কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেছেন তাদের।
এদিন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের উপস্থিতিতে শুনানির এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি তাদের আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, আপনার মক্কেলকে সুরক্ষা দিতে না পারলে আদালতে আসবেন না। আপনারা যতই ক্ষমতারধর হন না আইন সোজা পথে চলে। আকাবাঁকা পথে চলে না। আমরা অনেক সহ্য করেছি। সংবিধান রক্ষায় যে কোনো আদেশ দিতে আমরা কুণ্ঠাবোধ করবো না। আপনি যেই হোন।
তিনি বলেন, এই কোর্ট সংবিধানের অঙ্গ, সরকারের অঙ্গ নয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। মন্ত্রী শুধু প্রধান বিচারপতিকে ছোট করেননি, গোটা বিচার বিভাগকে পদদলিত করেছেন।
তিনি আরো বলেন, ধরুন প্রধান বিচারপতিকে এক হাজার কোটি টাকা দিয়ে কিনলেন অন্য চার বিচারপতিকে কীভাবে কিনবেন। কেনা সম্ভব নয়। প্রধান বিচারপতি একা কোনো রায় দেন না। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে পরামর্শ করে রায় দেন। অন্য বিচারপতিরাও আলাদা রায় দিতে পারেন।
রোববার সকালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত সদস্যের বেঞ্চে দুই মন্ত্রীর আদালত অবমাননার অভিযোগের বিষয়ে শুনানি হয়। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মু. আ ক ম মোজাম্মেল হকের পক্ষে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আদালতে শুনানি করেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা জনকণ্ঠের রায়ে বলে দিয়েছি। মন্ত্রীকে প্রশ্ন করি, আপনি কাসেমের (মীর কাসেম) রায় পড়েছেন। কিন্তু ওনারা (আইনজীবীরা) জনকণ্ঠের রায় পড়েছেন। কাসেমের রায়কে প্রভাবিত করতে মন্তব্য করেছেন কি না আমার সন্দেহ হয়। প্রধান বিচারপতি ও বিচার বিভাগকে স্ক্যান্ডালাইজ (কলঙ্কিত) করেছেন। প্রধান বিচারপতি যদি আদালত অবমাননার মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাহলে লাখ লাখ মামলার কী হবে?
এরপর কামরুল ইসলামের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনার ব্যাখ্যা হয়নি। এটা আমরা রিজেক্ট করলাম। পড়ালেখা করে আসেন। আপনার জবাব (প্যারা ৫) সাঙ্ঘাতিক ঔদ্ধত্যপূর্ণ।
আর রফিক-উল হককে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি জনকণ্ঠের রায় পড়েছেন? সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানতে কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি না?
প্রধান বিচারপতি এরপর তাদের দু’জনেক উদ্দেশ করে বলেন, বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ ফৌজদারি অপরাধ। ডাকাতি মামলার আসামির যেমন ফোজদারি অপরাধ, এটাও একই অপরাধ। জনকণ্ঠের মামলায় বলে দিয়েছি।
দুই মন্ত্রী শপথ ভঙ্গ করেছেন এমন মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, ‘আপনি স্বীকার করেছেন অপরাধ করেছেন। আপনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। এখন কী হবে? টকশোতে যাবেন বাড়াবাড়ি করবেন। এটা আর দেখতে চাই না। সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ পড়েন। আপনি সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। আপনি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। এর পরিণতি কী হবে?’
‘দেশ চলতে হলে সংবিধান রক্ষা করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী দেশ চলবে। তারা কী ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছে! একজন প্রসিকিউটর রায় নিয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যানকে দেখিয়েছেন। জানতে চেয়েছেন ঠিক আছে কি না? তিনি বলেছেন রায় ঠিক আছে। আপনারা সুপ্রিমকোর্টকে কোথায় নিয়ে গেছেন? কোন লেবেলে নিয়ে গেছেন?’
প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, ‘আমরা তো সংবিধানের বাইরে রায় দিতে পারি না। আমরা সংবিধানের চুল পরিমাণ ব্যত্যয় করতে পারি না। আপনি শপথ নিয়েছেন। আপনার স্বীকার করা আর জনকণ্ঠের সাংবাদিকদেরও অপরাধ এক কি না? দোষ স্বীকার করার পর কী হতে পারে। একজন অপরাধীকে যখন ডকে আনা হয় বলা হয়- তুমি দোষী না নির্দোষ? যখন সে বলে দোষ স্বীকার করছি ক্ষমা করেন। তখন কোর্ট কী করবে?’
জবাবে রফিক উল হক জবাবে বলেন, ‘সিম্পল পানিশমেন্ট দিতে পারে। আমি তো অন্যায় করেছি মাফ চেয়েছি।’
বাসেত মজুমদার বলেন, ‘মার্সি যখন চাই তখন তো দোষ স্বীকার করে চাই। আমরা ক্ষমা চেয়েছি। পুরো বিষয়টি আদালতের হাতে।’
তখন বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া বলেন, ‘আমাদের প্রথা হচ্ছে ক্ষমা দুই লাইনে চাইতে হয়। হোয়াট ইজ দিস? আপনারা বিশাল ব্যাখ্যা দিয়েছেন।’
মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা জানি বাংলাদেশে কারা মুক্তিযোদ্ধা। কার কী ভূমিকা। প্রধান বিচারপতি যদি ওই মামলা (মীর কাসেম) থেকে নিজেকে তুলে নিতেন, দেশে রায়ট (দাঙ্গা) লেগে যেতো। পুরো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল হয়ে যেতো। এখানে আমরা অনেক সিদ্ধান্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে।’
বাসেত মজুমদার বলেন, ‘আমরা যথাযথভাবে আবেদন দেব। সময় চাই।’
পরে আদালত সময় আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ২৭ মার্চ সকাল ৯টায় এই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন।
প্রসঙ্গত, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা মীর কাসেমের মামলার বিচারকাজে তদন্ত সংস্থার ‘গাফিলতি’র কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং তদন্ত সংস্থা যে গাফিলতি করেছে এজন্য তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত।’
প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্যের পর আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতি থাকলে খতিয়ে দেখা হবে।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ মার্চ প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের আপিলের পুনঃশুনানি দাবি করেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এই মামলার রায় কী হবে তা প্রধান বিচারপতির প্রকাশ্যে আদালতে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি। তার বক্তব্যের মধ্যে এটা অনুধাবন করেছি, এই মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। জামায়াত-শিবিরের আন্তর্জাতিক লবিস্টরা যে সুরে কথা বলছে একই সুরে কথা বলছেন প্রধান বিচারপতি। তাদের অভিযোগগুলোর সত্যতা দিয়েছেন তিনি।
‘শুধু তা-ই নয় এই বক্তব্যের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের গত ৫ বছরের বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ ও হত্যা করা হয়েছে। আমি মনে করি প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন করে শুনানি হওয়া উচিত। উনাকে (এসকে সিনহা) বাদ দিয়ে মীর কাসেমের শুনানি পুনরায় শুরু করুন।’
খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে ৪৫ বছরে অনেক বিচারপতি এসেছে আর গেছে, কিন্তু কেউ তার মতো এত অতিবক্তব্য দেয়নি। তার অতিকথনে সুধী সমাজের মানুষেরা জিহ্বায় কামড় দিচ্ছেন। তাই তাকে অতিকথন থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি। আর তা না হলে সরকারের নতুন করে বিকল্প চিন্তাভাবনা করা উচিত বলে আমি মনে করছি।’
আর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলছি, এই রায় নিয়ে শঙ্কা এখন সংকটে পরিণত হয়েছে। তবে এ সংকট আমাদের সৃষ্ট নয়। সংকট সৃষ্টি করেছেন প্রধান বিচারপতি। এটাই আমাদের দুঃখ। রায়ের আগে প্রধান বিচারপতি যদি এমন কথা বলেন, তাহলে জাতি কোথায় যাবে?’
সরকারের দুই মন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে কথার উত্তাপ। আইনজীবীসহ দেশের বিশিষ্টজনেরা বলেছেন চূড়ান্ত রায়ের আগে দুই মন্ত্রীর বক্তব্য দেয়া ঠিক হয়নি। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, তাদের বক্তব্য অসাংবিধানিক।