ঢাকা: বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় মুদ্রা পাচার ও তথ্য প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় আগামী ১৯ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বুধবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাহবুবুর রহমান ওই নির্দেশ দেন বলে বাংলামেইলকে জানিয়েছেন আদালতে পুলিশের মতিঝিল-পল্টন শাখার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এসআই জালাল আহমেদ।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচিত এই ঘটনায় গতকাল ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় এই মামলাটি দায়ের করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা।
মামলাটিতে সরাসরি কাউকে আসামি করা হয়নি বলে জানা গেছে। মামলাটি তদন্ত করার জন্য কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিআইডিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরির পর প্রায় দেড় মাস বিষয়টি গোপন রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ফিলিপাইন মিডিয়ায় এ সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশিত হলে তা ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ মিডিয়ায়ও। এ ঘটনায় বেশ বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হয় সরকার। অবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে পদত্যাগ করতে হয়। দেশের মিডিয়ায় আসার চারদিন পর এ মামলাটি করলো বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের ব্যাংক হিসাবে রক্ষিত বাংলাদেশের হিসাব থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি করা হয়েছে। এর একটি অংশ (২০ মিলিয়ন) গেছে শ্রীলঙ্কায়, আরেকটি অংশ (৮১ মিলিয়ন) গেছে ফিলিপাইনে। সম্প্রতি ফিলিপাইনের একটি ইংরেজি দৈনিকে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তাতে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ফিলিপাইনে পাচার হওয়ার কথা উল্লেখ ছিল।
গত সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মোট ৮০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ ডলার চুরি করে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায়। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কা থেকে অর্থ উদ্ধার করা হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের ইংরেজি দৈনিক ইনকোয়ারারে প্রথম এ সংক্রান্ত প্রদিতবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, দেশটির মাকাতি শহরে অবস্থিত রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) একটি শাখার পাঁচটি অ্যাকাউন্টে ৮১ মিলিয়ন ডলার আসে। এতে ওই ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ মিলেছে। ওই টাকা পরে বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ফিলরেম নামের এক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চলে যায় তিনটি ক্যাসিনোয়। সেখান থেকে হংকংয়ে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করা হয়। যে তিনটি ক্যাসিনোর হাত ঘুরে তা অন্য দেশে পাচার হয়েছে, সেগুলো হলো সোলাইরি রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনো, সিটি অব ড্রিমস ম্যানিলা ও মাইডাস হোটেল অ্যান্ড ক্যাসিনো।
এ নিয়ে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদত্যাগ করেছেন। চাকরি হারিয়েছেন তিন কর্মকর্তা। আরো অনেকে চাকরিচ্যুত হওয়ার তালিকায় আছেন বলে জানা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এতোবড় চুরি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে :
আমি (জোবায়ের বিন হুদা) গত ৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার শাখার যাবতীয় কার্যাবলী সম্পাদন শেষে রাত আনুমানিক ৮:৩০টায় শাখার কর্মকর্তাগণসহ অফিস ত্যাগ করি।
সুইফট লেনদেনের নিয়ম মোতাবেক পরবর্তী দিন ৫ ফেব্রুয়ারি আগের দিনের লেনদেনসমূহের নিশ্চয়তা বার্তা সুইফট কক্ষে রক্ষিত প্রিন্টারে প্রিন্ট হওয়ার কথা। ৫ ফেব্রুয়ারি আনুমানিক সকাল পৌনে ৯টার সময় আমি অফিসে আসি। আনুমানিক সাড়ে ১০টার সময় অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর রফিক আহমাদ মজুমদার সুইফট কক্ষে আগের দিনের নিশ্চয়তা বার্তাসমূহ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, সুইফ সার্ভার এ লগিন করা সত্ত্বেও ম্যাসেজসমূহ প্রিন্টারটিতে স্বয়ংক্রিয়ভাব প্রিন্ট হচ্ছে না।
এ অবস্থায় রফিকসহ আমি ম্যানুয়ালি বার্তাসমূহ প্রিন্ট করার বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। প্রিন্টিং সংক্রান্ত সমস্যা এর আগেও বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে বিধায় উদ্ভূত সমস্যাকে অন্যান্য দিনের সমস্যার মতো মনে করি।
এ সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রাখার জন্য শাখার অন্যান্য কর্মকর্তাগণকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দেই এবং বিষয়টি আমাকে অবহিত করার জন্যও তাদেরকে অনুরোধ করে আমি আনুমানিক বেলা সোয়া ১১টায় অফিস ত্যাগ করি। দিনটি শুক্রবার হওয়ায় সমস্যাটি নিয়ে পুনরায় পরদিন শনিবার কাজ করা হবে মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়ে উপস্থিত অন্য কর্মকর্তাগণ আনুমানিক বেলা সাড়ে ১২টার সময় অফিস ত্যাগ করেন বলে পরে আমি জানতে পারি।
পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল আনুমানিক ৯টার সময় অফিসে আসি এবং সহকর্মীদের সহায়তা নিয়ে প্রিন্টিং সংক্রান্ত সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করি। এ সময় লক্ষ্য করি সুইফটের বিদ্যমান সফটওয়্যারটি চালু হচ্ছে না। সফটওয়্যারটি চালু করতে গেলেই মনিটরে স্বয়ংক্রিয় বার্তা ‘ফাইল ইজ মিসিং অর চেঞ্জড’ (একটি ফাইল পাওয়া যাচ্ছে না অথবা পরবর্তিত হয়ে গেছে) এবং “nroff.exe” নামের একটি ফাইলের নাম ফোল্ডারপাথসহ (folder path) নির্দেশ করছিল।
সেই নির্দেশনা মোতাবেক টেস্ট সার্ভারের সঙ্গে ক্রসচেক করে সমাধানের চেষ্টা করি এবং আনুমানিক দুপুর সাড়ে ১২টার সময় সফট্ওয়্যাটি বিকল্প পদ্ধতিতে চালু করতে সক্ষম হই। তখনও স্বয়ংক্রিয় প্রিন্টিং সমস্যাটির সমাধান করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাকের হোসেন এবং মহাব্যবস্থাপক বি এইচ খানকে অবহিত করি এবং তাদের মৌখিক অনুমোদন নিয়ে বিকল্প পদ্ধতিতে ম্যানুয়ালি বার্তাসমূহ প্রিন্ট করতে সক্ষম হই।
প্রিন্টকৃত বার্তাসমূজ স্বাভাবিক নিয়মে সর্টিং করার সময় দেখা যায় যে, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক থেকে তিনটি ভিন্ন ধরনের মেসেজের মাধ্যমে কিছু কোয়ারি (তথ্য জানতে চাওয়া) করা হয়। এর মধ্যে প্রথম মেসেজটি আমাদের সিস্টেমে রিসিভ হয় ৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ২৪ মিনিটে, যা আনুমানিক দুপুর সাড়ে ১২টার পর প্রিন্ট নেয়া সম্ভব হয় যেখানে ১২টি ট্রানজেকশনের (লেনদেন) কোয়ারি করা হয়। অপর দুটি মেসেজে আমাদের সিস্টেমে রিসিভ হয় ৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টা ৮ মিনিটে, যেখানে একটি মেসেজে চারটি ট্রানজেকশনের ব্যাপারে এবং আরেকটিতে ৩০টি ট্রানজেকশনের ব্যাপার কিছু কোয়ারি করা হয়। এখানে ৩০টি ট্রানজেকশনের ব্যাপারে তারা পেমেন্টের (অর্থ পরিশোধ) ব্যাপারে অধিকতর ক্ল্যারিফিকেশনের (যাচাই) জন্য অনুরোধ জানায়।