রিভিউ আবেদন করবেন, ছেলে ও আইনজীবীদেরও জানালেন নিজামী

Slider জাতীয়

nujami_352894541

 

 

 

 

গাজীপুর: মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে দেখা করে এসে তার ছেলে ও আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তিনি আপিল বিভাগের ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রিভিউ আবেদন করতে বলেছেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন।

বুধবার (১৬ মার্চ) দুপুর দেড়টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২ এর ভেতরে গিয়ে নিজামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার ছেলে ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান এবং মতিউর রহমান আকন্দ ও মশিউল আলমসহ কয়েকজন আইনজীবী। একটার দিকে কারাফটকে আসেন তারা, পরে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে সাক্ষাতের আবেদন জমা দেন। আবেদন মঞ্জুর হলে কারাগারের ভেতরে ঢোকেন।

এক ঘণ্টা সাক্ষাৎ শেষে বের হয়ে কারাফটকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মতিউর রহমান আকন্দ। তিনি জানান, ১৫ দিন সময় আছে। এর মধ্যেই সময়-সুযোগ মতো রিভিউ আবেদন জানাবেন তারা।

নিজামীকে যেসব অভিযোগে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, সেসব ঘটনার সময় তিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন না বলে দাবি করেন এই আইনজীবী।

এর আগে সকালে মৃত্যু পরোয়ানা শোনার সময়ই নিজামী কারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, তিনি আপিল মামলার চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ের রিভিউ চেয়ে আবেদন করবেন।

সকাল ৯টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে লাল কাপড়ে মোড়ানো নিজামীর মৃত্যু পরোয়ানা ও পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি এসে পৌঁছায়। পরে সকাল ১০টা ০৫ মিনিটে কনডেম সেলে গিয়ে তাকে পরোয়ানা ও রায় পড়ে শোনান কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২ এর জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক ও জেলার নাসিরউদ্দিন।

এ সময় মতিউর রহমান নিজামী জেল সুপারকে জানান, তার আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে আপিল বিভাগে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রিভিউ আবেদন করবেন।

মৃত্যু পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে দেশের এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকরের আইনি প্রক্রিয়া। আর আসামি সে পরোয়ানা শোনার পর শুরু হয়েছে রিভিউয়ের দিন গণনা। আইন অনুসারে নিজামী রিভিউ আবেদন করতে পারবেন ১৫ দিনের মধ্যে, যার শেষ দিন আগামী ৩০ মার্চ।

মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) বিকেলে ১৫৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

রায়টি রাতে বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার উল হক এবং বিচারিক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

রাতেই সেটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়, ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা প্রশাসক) কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গত ০৬ জানুয়ারি নিজামীর মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত রায় দেন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ একাত্তরে গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে আলবদর বাহিনীর শীর্ষনেতা নিজামীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নিখিল পাকিস্তানের সভাপতি হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীর সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন নিজামী। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা ছাড়াও সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) হিসেবে আলবদর বাহিনী ও ছাত্রসংঘের অপরাধের দায়ও তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে রায়ে।

নিজামীকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং হত্যা-গণহত্যা ও ধর্ষণসহ সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) প্রমাণিত ৮টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে ৪টিতে ফাঁসি ও ৪টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ৩টিতে ফাঁসি ও ২টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। অন্য তিনটিতে চূড়ান্ত রায়ে দণ্ড থেকে খালাস পেয়েছেন নিজামী, যার মধ্যে একটিতে ফাঁসি ও দু’টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ ছিল ট্রাইব্যুনালের রায়ে।

ট্রাইব্যুনালে নিজামীর বিরুদ্ধে মোট ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ৮টি অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল ট্রাইব্যুনালের রায়ে।

প্রমাণিত চারটি অর্থাৎ সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়িসহ দু’টি গ্রামে প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে গণহত্যা ও প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ (২ নম্বর অভিযোগ), করমজা গ্রামে ১০ জনকে গণহত্যা, একজনকে ধর্ষণসহ বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ (৪ নম্বর অভিযোগ), ধুলাউড়ি গ্রামে ৫২ জনকে গণহত্যা (৬ নম্বর অভিযোগ) এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ও সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (১৬ নম্বর অভিযোগ) দায়ে নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল।

এর মধ্যে ৪ নম্বর অভিযোগের দায় থেকে নিজামীকে খালাস দিয়ে বাকি তিনটিতে ফাঁসি বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।

অন্য চারটি অর্থাৎ পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিন হত্যা (১ নম্বর অভিযোগ), মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র (৩ নম্বর অভিযোগ), বৃশালিখা গ্রামের সোহরাব আলী হত্যা (৭ নম্বর অভিযোগ) এবং রুমী, বদি, জালালসহ সাত গেরিলা যোদ্ধা হত্যার প্ররোচনার (৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল।

এর মধ্যে ১ ও ৩ নম্বর অভিযোগের দায় থেকে চূড়ান্ত রায়ে খালাস পেয়েছেন নিজামী। বাকি দু’টিতে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ বহাল রয়েছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি আনোয়ারুল হক ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন নিজামীকে।

এ রায়ের বিরুদ্ধে ২৩ নভেম্বর আপিল করেন নিজামী। ছয় হাজার ২শ’ ৫২ পৃষ্ঠার আপিলে মোট ১শ’ ৬৮টি কারণ দেখিয়ে ফাঁসির আদেশ বাতিল করে খালাস চেয়েছিলেন তিনি।

তবে সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় আপিল করেননি রাষ্ট্রপক্ষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *