ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের দিনক্ষণ যত কাছাকাছি আসছে, নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা তত বাড়ছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলায় সহিংসতায় আহত হয়েছেন কয়েক শ লোক। নিহত হয়েছেন কমপক্ষে চারজন। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে বিএনপির প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের ওপর হামলা এবং নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠছে।
গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, বগুড়া, পিরোজপুর, বাগেরহাট, ভোলা, ঝালকাঠি ও পাবনা জেলার কমপক্ষে ১০টি ইউনিয়নে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ, বরগুনা ও লক্ষ্মীপুরে বিএনপি-মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং তাঁদের সমর্থকদের ওপর হামলা ও নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় অন্তত ১৩০ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া ভোলা সদর উপজেলার চরসামাইয়া ইউনিয়নে নির্বাচনী সংঘর্ষে আহত হওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাতে মারা গেছেন একজন।
এর আগে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আদাবাড়িয়া ইউনিয়নে সোমবার আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন আওয়ামী লীগ-মনোনীত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সামসুল হকের খালাতো ভাই আশরাফ ফকির (৩৫)। পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলায় গত মঙ্গলবার রাতে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন বিএনপির চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর ভাগনে ছাত্রদল নেতা শামসুল হক (২৮)। এর আগে ২২ ফেব্রুয়ারি বরগুনার আমতলীর হলদিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে নিহত হন বশির উদ্দিন (৩৫)।
ঢাকার বাইরে নিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক কার্যালয় ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
ভোলা: সদর উপজেলার চরসামাইয়া ইউনিয়নের শান্তিরহাট শনিরকান্দি গ্রামে বৃহস্পতিবার রাতে সিরাজুল ইসলাম (৫৫) নামের এক দিনমজুর মারা গেছেন। তাঁর স্ত্রী কমলা অভিযোগ করেন, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেনের লোকজন রাত একটার দিকে সিরাজকে মারধর করেন। পরিবারের সদস্যরা আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে ঘরে এনে শুইয়ে দেন। সকালের দিকে তিনি মারা যান। তিনি ইউপি সদস্য প্রার্থী বজলুর রহমানের সমর্থক।
এ ঘটনায় বজলুর রহমান ও জাহাঙ্গীর হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে গতকাল কয়েক দফা পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
এদিকে গতকাল সকালে বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য প্রার্থী আনোয়ার হোসেনের সমর্থকদের ওপর আরেক প্রার্থী ফজলুর রহমানের লোকজন অতর্কিত হামলা চালান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে আনোয়ার হোসেনসহ ১৫ জন আহত হয়েছেন।
লক্ষ্মীপুর: কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ ইউপি নির্বাচনে বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী মোসলেহ উদ্দিনের ওপর গতকাল হামলার ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় হামলায় মোসলেহ উদ্দিনসহ ২০ জন আহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ফয়সাল আহমদ রতনের সমর্থকেরা হামলায় জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন মোসলেহ উদ্দিন। ফাজিল ব্যাপারীরহাটে মোসলেহ উদ্দিনের নির্বাচনী কার্যালয়েও ভাঙচুর করা হয়েছে।
ফয়সাল আহমদ বলেন, গণসংযোগের সময় বিএনপির লোকজন ভোটারদের কাছে আপত্তিকর ও অশোভন কথাবার্তা বলেন। এতে স্থানীয় লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে মোসলেহ উদ্দিন ও তাঁর কর্মীদের ধাওয়া দেন।
কুমিল্লা: বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী বাছাইয়ে পরাজিত হয়ে ব্যালট পেপার ছিনতাই, যানবাহন ও কলেজের আসবাব ভাঙচুর করেছেন ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও বুড়িচং উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিল্লাল হোসেন। গতকাল সন্ধ্যায় ওই ঘটনা ঘটে। এ সময় বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, গতকাল বিকেলে ষোলনল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী বাছাই অনুষ্ঠান শুরু হয় খাড়াতাইয়া ফাজিল মাদ্রাসা মাঠে। এতে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতার জন্য ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলামের পক্ষে ভোট পড়ে ৩২টি, বিল্লাল হোসেন পেয়েছেন ২০ ভোট। ফলাফল ঘোষণার পর বিল্লাল হোসেন তাঁর সমর্থকদের নিয়ে ব্যালট পেপার ছিনতাই করেন। ভরাসার বাজারে গিয়ে ২০টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও যানবাহন ভাঙচুর করেন। একপর্যায়ে কাঠের গুঁড়ি সড়কের মধ্যে ফেলে রেখে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। কর্মীরা ভরাসার বাজারের পাশে সোনার বাংলা কলেজে ঢুকে কক্ষ ও আসবাব ভাঙচুর করেন।
নারায়ণগঞ্জ: রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই চেয়ারম্যান পদপ্রত্যাশীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ২৫ জন আহত হয়েছেন। গতকাল দুপুরে উপজেলার গোলাকান্দাইলের সাওঘাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
রূপগঞ্জ থানার ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আনোয়ার হোসেন বলেন, রূপগঞ্জ থানা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় গোলাকান্দাইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মনজুর হোসেন ভূঁইয়াকে ওই ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দেওয়া হয়। স্থানীয় যুবলীগ সমর্থক এস কে সোলায়মান আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন দাবি করেন। পরে এস কে সোলায়মান ও মনজুর হোসেনের সমর্থকেরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
বগুড়া: শেরপুর ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী বাছাই করা নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ১১ জন আহত হয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যায় উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের শেরুয়া বটতলা বাজারে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী বাছাই করা নিয়ে গতকাল বিকেলে শেরুয়া বটতলা এলাকায় একটি বিদ্যালয়ে দলীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৪৬ ভোট পেয়ে আলামিন মণ্ডল দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। প্রতিদ্বন্দ্বী অপর প্রার্থী আবু তালেব আকন্দ পান ৩৭ ভোট। এ সময় কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
বাগেরহাট: গতকাল মোল্লাহাট উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের উদয়পুর ও আস্তাইল গ্রামের দুজন ইউপি সদস্যের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে উভয় পক্ষে ৮ জন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ৩৩ জন আহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ ৮ জনসহ ১৩ জনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
মোল্লাহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আ ন ম খায়রুল আনাম বলেন, উদয়পুর ইউনিয়নের নির্বাচনে আজিজুর রহমান এবং কামরুল মোল্ল্যা ইউপি সদস্য প্রার্থী হয়েছেন। গতকাল সকালে উভয় পক্ষে দুই শতাধিক লোক ইটপাটকেল, লাঠিসোঁটা, দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে উদয়পুর উত্তরকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
ঝালকাঠি: কাঁঠালিয়া উপজেলার পাটকেলঘাটা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ-মনোনীত প্রার্থী শিশির দাস ও বিদ্রোহী প্রার্থী সহিদুল ইসলামের সমর্থকদের মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় জোড়খালী বাজারে বিদ্রোহী প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়।
পুলিশ জানায়, রাত ১০টার দিকে জোড়খালী বাজারে দুই প্রার্থীর তিন শতাধিক নেতা-কর্মী দেশীয় রামদা, ছেনি, লাঠিসোঁটা নিয়ে একে অপরকে ধাওয়া করেন। এতে পুরো বাজার এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে দুই পক্ষের অন্তত ১২ জন আহত হয়েছেন।
পিরোজপুর: নেছারাবাদ উপজেলার দৈহারি ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী প্রগতি মণ্ডল ও বিদ্রোহী প্রার্থী মিজানুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন।
পাবনা: বেড়া উপজেলার চাকলা ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী শামীমুল ইসলামের বাড়িতে গতকাল বিকেলে হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় বাসিন্দাদের মারপিট, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। শামীমুল ইসলাম হামলায় আওয়ামী লীগ-মনোনীত প্রার্থী ফারুখ হোসেনের সমর্থকদের দায়ী করেছেন। হামলায় শামীমুলের মা লাইমুনা ও স্ত্রী সাবানাসহ বাড়ির অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ: রায়গঞ্জ উপজেলার ৬ নম্বর ধানগড়া ইউপি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে। বিএনপির প্রার্থী শামসুল ইসলাম রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগ দেন, তাঁর প্রচারকাজে বাধা দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মীর ওবায়দুল ইসলামের লোকজন।
বরগুনা: বামনা উপজেলার সদর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিএনপির প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণায় বাধা, মারধর ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিএনপির প্রার্থী এনায়েত কবির হাওলাদার বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী চৌধুরী কামরুজ্জামান সগির ও সমর্থকদের হামলা ও হুমকিতে তাঁর সমর্থকেরা কোনো প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারছেন না।