আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের এলাকায় সহিংসতার আশঙ্কা

Slider গ্রাম বাংলা জাতীয়

2016_02_18_18_30_13_z52hHVpOPVVNlIJyjwjfO416IRgp7u_original

 

যেসব এলাকায় বিএনপির কোনো প্রার্থী নেই ও আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী রয়েছে, সেসব এলাকায় ব্যাপক আকারে সহিংসতা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গতকাল শেরেবাংলা নগর এনইসি সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সভা করে নির্বাচন কমিশন। সভায় একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে আশঙ্কা করা হয়, অন্য যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে এই নির্বাচনে অপ্রীতিকর ঘটনা বেশি ঘটতে পারে। পরিস্থিতির দায় সরকারের ওপর চাপাতে ২০ দল তৎপর থাকবে বলেও তাদের অভিমত। বৈঠকে রিটার্নিং অফিসার ও প্রিজাইডিং অফিসারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এছাড়া সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতারা গ্রেপ্তারে পুলিশকে প্রভাবিত করছে বলেও অভিযোগ করা হয়। পুরো নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করা বড় ধরনের চাপ মন্তব্য করে নির্বাচনকে পুনর্বিন্যস্ত করার দাবি তোলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ৫ নির্বাচন কমিশনার, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, পুলিশের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটওয়ারীসহ বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপার ও জেলার প্রশাসকরা। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জেলা নির্বাচন অফিসার ও রিটার্নিং কর্মকর্তারাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, শুরুতে গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী রয়েছে। সেসব এলাকায় তাদের নিজেদের মধ্যে মারামারি বেঁধে যেতে পারে। এটা নিয়ে নির্বাচনে আরেকটি মাত্রা তৈরি হবে। এটা যেন না করতে পারে, সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। এছাড়া গ্রেপ্তার অভিযান আরও জোরদার করতে হবে। একই আশঙ্কা প্রকাশ করেন অন্য আরেকটি শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি। ওই সংস্থার উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা তার বক্তব্যে বলেন, বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী নেই। যেগুলোতে আওয়ামী লীগের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী আছে, ওইসব এলাকায় সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি বলেন, এই নির্বাচন দলীয় পর্যায়ে হওয়ার কারণে পাড়ায় পাড়ায় পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দলীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। অন্যান্য নির্বাচনের তুলনায় এ নির্বাচনে অপ্রীতিকর ঘটনা বেশি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর হামলা হতে পারে। এজন্য  তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা জোরদার করা দরকার। ২০ দলীয় জোট পরিস্থিতির দায় সরকারের ওপর চাপাতে পারে। প্রভাবশালী নেতাদের এলাকায় একই দল থেকে একাধিক প্রার্থী থাকায় গ্রুপিং তৈরি হতে পারে বলেও মত দেন তিনি। তিনি আরও বলেন, মিডিয়া অপপ্রচার করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা, সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের ভাবা উচিত। এছাড়া পার্বত্য এলাকায় নিরাপত্তা সমস্যা আছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রভাব বিস্তার করে সংঘাতময় পরিবেশ তৈরি করতে পারে। তাই পুরো পার্বত্য অঞ্চলের সব ইউপিতে একই দিনে নির্বাচন হওয়া উচিত। না হলে সন্ত্রাসীরা এক এলাকার নির্বাচন শেষ করে অন্য এলাকায় গিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করবে।
বৈঠক সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন আরও বাড়ানোর পক্ষে মত দেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। যদিও পুলিশ বলেছে, পুরো নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য নেই। তাই নির্বাচনকে পুনর্বিন্যস্ত করার দাবি তোলেন তারা। বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি বলেন, আমার ৬ জেলার ৩৫০টি ইউপিতে একদিনে নির্বাচন। ওই পরিমাণ পুলিশ সদস্য আমার রেঞ্জে নেই। আর ভোটের দিন কী অন্য কোনো অপরাধ ঘটবে না? যদি সব পুলিশ নির্বাচনেই পাহারা দেয়, তাহলে বাকি পরিস্থিতি কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবো। একই বক্তব্য দেন পুলিশ হেড কোয়ার্টারের ডিআইজিও। এছাড়া অনেক পুলিশ সুপারই এ ব্যাপারে আপত্তি তোলেন। তাদের মতে, ৬ ধাপে নির্বাচন করা পুলিশের জন্য অনেক বড় চাপ হয়ে যাবে। আরও কয়েক ধাপ বাড়ানো উচিত বলে মত দেন তারা। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা অনেকটা সুবিধাজনক হবে। সভায় বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, সব বিজিবি সদস্য যদি নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সীমন্ত এলাকা অরক্ষিত হয়ে যেতে পারে। এদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও প্রিজাইডিং অফিসারদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। বরিশাল বিভাগের এক পুলিশ সুপার বলেন, অনেক সময় দেখা যায় রিটার্নিং অফিসাররা স্বজনপ্রীতি দেখান। আর প্রিজাইডিং অফিসাররা খুব সহজে ম্যানেজ হয়ে যান। দেখা গেল বাইরে পুলিশ নিরাপত্তা দিচ্ছে, ভেতরে প্রিজাইডিং অফিসার অনৈতিক কাজ করছেন। এক্ষেত্রে এক জায়গার প্রিজাইডিং অফিসারকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত। এমনকি ভোটকেন্দ্রের ভেতরটায়ও পুলিশকে নজরদারির করার সুযোগ দেয়া উচিত। এই এসপি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন লোক গ্রেপ্তার করার জন্য আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে থাকেন। এ নিয়ে আমরা ঝামেলার মধ্যে আছি। আরেকজন এসপি বলেন, নির্বাচন বিষয়ক ট্রেনিংয়ে পুলিশকে রাখা হয় না। এটাতে পুলিশের অন্তর্ভুক্তি জরুরি। তাহলে নির্বাচনী কাজে সহায়তা করা পুলিশের জন্য আরও সহজ হবে। এদিকে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক তার বক্তব্যে পুলিশের দিকে অভিযোগের তীর ছোড়েন। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের ক্ষেত্রে পুলিশ সুপাররা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতাটা রেখে দেয়। এর মধ্যে জেলা প্রশাসককে সম্পৃক্ত করতে চায় না। এটা ভেবে দেখা উচিত।
নির্বাচন কমিশনার জাবেদ আলী বলেন, একদল বলে আমরা বিমাতাসুলভ আচরণ করছি। আরেক দল বলে আমরা সরকারের পকেটে ঢুকে গেছি। দুটাই যেন মিথ্যা হয়, আমাদের সেই অনুযায়ী কাজ করা উচিত। আরেক নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, আমরা যে সর্বাঙ্গীণভাবে ভালো করতে পারছি, সেটা বলা যাবে না। দু-একজন এমন কাজ করেছে, যার জন্য নির্বাচন কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এটা যাতে আর না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সভায় সমাপনী বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ বলেন, দু-একটি জায়গায় গণ্ডগোল হওয়ার কারণে পুরো নির্বাচনে সফল হতে পারি না আমরা। এসব কিছুর দায়দায়িত্ব পুলিশের ওসিদের নিতে হবে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। কেন্দ্র দখল করতে দেয়া যাবে না। গুলি থাকা অবস্থায় যাতে কোনো কেন্দ্র দখল করতে না পারে কেউ। সর্বশেষ বুলেটটি ব্যবহার করে হলেও কেন্দ্র বাঁচাতে হবে। এ সময় পুলিশের দাবি অনুযায়ী ৬ ধাপের নির্বাচনকে পুনর্বিন্যস্ত করার আশ্বাস দেন।
সভা থেকে বেরিয়ে সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, যেহেতু এটা দলীয় ভিত্তিতে প্রথম ইউপি নির্বাচন, তাই রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের প্রার্থীরা যেন নিজেরাই সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করে। কোনো সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে নিজের পাড়ার নির্বাচন সৌহার্দপূর্ণ করার ব্যবস্থা করবেন। আমরাও সবাইকে সহযোগিতা করবো। সিইসি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে বলে দেয়া হয়েছে, তারা যেন আইন মোতাবেক তাদের দায়িত্ব পালন করেন। কোনো পক্ষপাতিত্ব না করেন।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী হওয়ার ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে মনে করেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে দেখতে হবে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ায় কোনো বাধা সৃষ্টি হয়েছে কিনা। যদি মনোনয়নপত্র জমা দেয়ায় বাধা সৃষ্টি না হয়, তাহলে একজন কী দশজন প্রার্থী হলো, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। সিইসি বলেন, এমনিতেই আমরা অনেক খবর পাই। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে খবর না পেলে ব্যবস্থা নেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। সিইসি বলেন, ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট ও কারচুপি কর্মকাণ্ড বরদাশত করা হবে না। তিনি বলেন, যারা কেন্দ্র দখল করে রাতে কারচুপি করে, দিনে জালভোট দেয়, তারা কোনো দলের নয়, তারা সন্ত্রাসী। সিইসি জানান, যাদেরকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়া হচ্ছে না, তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করেছি। তাছাড়া অতি দ্রুত অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রথম ধাপের যারা মনোনয়নপত্র জমা দেয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের বিষয়ে ইসির ভূমিকা কী থাকবে? জবাবে সিইসি বলেন, এরকম ঢালাও কথার ওপর কোনো কাজ হবে না। আমাদের আইন মোতাবেক কাজ করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *