খাদ্য বিষক্রিয়ায় নয়, অরণী ও আলভিকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। তাদের গলাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ময়না তদন্ত শেষে ডাক্তার প্রাথমিকভাবে অরণী ও আলভিকে হত্যার কথাই বলেছেন। এদিকে, হত্যার ঘটনায় চারজনকে আটক করেছে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব। দুই শিশু হত্যার ঘটনায় বাবা-মাও এখন সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন। দুই ভাই-বোনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে খবর রটানো হয়েছিলো চাইনিজ খেয়ে তারা মারা গেছে।
বনশ্রীর ৪ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাসায় সোমবার বিকেলে দুই আপন ভাই-বোন সিদ্ধেশ্বরীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী নুশরাত জাহান অরণী (১৪) ও হলিক্রিসেন্ট স্কুলের নার্সারির শিক্ষার্থী আলভী আমানের (৬) লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ দু’টি ওইদিনই ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। গতকাল সকালে দুই ভাই-বোনের লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়।
ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস ময়নাতদন্ত শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দু’জনের শরীরেই আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। অরণীর চোখে রক্ত জমাট ও গলায় আঘাত এবং আলভীর পায় ও গলায় আঘাত রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে তাদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।’ ফুড পয়জনিং হয়েছিল কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভিসেরা রিপোর্ট হাতে পেলে বিষয়টি জানা যাবে।’
এদিকে, তাদেরকে শ্বাসরোধে হত্যার বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পরে একজন শিক্ষক, বাড়ির দারোয়ান ও নিহতের দুই স্বজনকে আটক করেছে র্যাব। আটককৃতরা হলো গৃহশিক্ষিকা শিউলি, দারোয়ান পিন্টু মন্ডল এবং দুই স্বজন ওবায়দুর ও শাহিন। আজ মঙ্গলবার দুপুরের দিকে তাদেরকে আটক করা হয়। র্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেছেন, তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়া হয়েছে। এর আগে, যে রেস্টুরেন্টের খাবার খেয়ে দুই ভাই-বোন মারা গিয়েছে বলে পরিবার থেকে বলা হয়েছিলো সে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার, প্রধান বাবুর্চিসহ তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। আটকরা হলেন, ওই চাইনিজের ম্যানেজার মাসুদ রহমান, প্রধান বাবুর্চি আসাদুজ্জামান রনি ও তার সহযোগী আতাউর রহমান।
রামপুরা থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, সোমবার রাতে তাদের গ্রেফতার করা হয়। নিহত অরণী ও আলভীর খালা আফরোজা মালেক নীলা জানান, অরণী ও আলভীর বাবা আমান উল্লাহ এবং মা মাহফুজা মালেক জেসমিন এরা চারজন রোববার রাতে একটি রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করে। সেখানে কিছু খাবার অবশিষ্ট হলে সেটা প্যাকেটে করে বাসায় নিয়ে আসে। সেই অবশিষ্ট খাবার দুই ভাই-বোন সোমবার দুপুরে খাওয়ার পরে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। এরপর বিকেলে তাদের ডাকাডাকি করা হলে তাদের কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যায়নি। পরে তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে রাত পোনে ৮টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
ময়না তদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ সোহেল মাহমুদ বলেন, দু’টি বাচ্চার গলায় তারা দাগ পেয়েছেন। সেখানে আঙুলের ছাপও ছিলো। থুতনিসহ বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। দু’জনের জিহ্বায় কামড় লেগে ছিলো। খাবারে বিষক্রিয়ার অভিযোগ আসার পরিপ্রেক্ষিতে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য নমুনাও পাঠানো হয়েছে। হত্যার আগে তাদেরকে অজ্ঞান করা হয়েছে কিনা তা ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরেই জানা যাবে বলে ডাক্তাররা জানিয়েছেন।
এদিকে, আজ বনশ্রীর বি-ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সেখানে কেউ নেই। প্রতিবেশিরা ঘটনার বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে যান বাড়িতে। এ সময় তারা বলতে থাকেন, সন্তান মারা গেছে; কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই বাবা-মার। তারা স্বজনের কাছে চাবি দিয়ে বাসা থেকে পালিয়েছেন। একজন মা কীভাবে এটা করতে পারেন? এরকম আরও নানা কথা।
স্থানীয় একজন নারী বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সোমবার ঘটনা শোনার পরপরই তিনি ওই বাড়িতে আসেন। ওই সময় দেখেন চারজন ছেলে এসে একটি গাড়িতে করে দুই ভাই-বোনকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। তবে ওই চারজনকে তিনি চেনেন না। এর আগেও কখনো দেখেননি তাদের। তিনি আরো জানান, সন্তানদের হাসপাতালে নেয়ার সময় বাবা-মাকে কোনো কান্না করতে দেখেননি তিনি।
স্থানীয়রা জানান, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ দেখে তারা বাড়িতে এসে খোঁজ নিচ্ছেন। এর আগে ঘটনা সম্পর্কে তারা জানতেন না। কোনো চেঁচামেচি বা কান্নার শব্দও পাননি তারা।
এদিকে ওই বাড়িতে গিয়ে ভাই-বোনের বাবা আমাউল্লাহ ও মা মাহফুজা মালেক দম্পতিকে পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায় ওবায়দুল নামের মাহফুজার মামাতো ভাইকে। ওবায়দুল দাবি করেন, তিনি মাহফুজার ফুফাতো ভাই। সাভারের বাসিন্দা। সেখানে বালিয়াপুরের একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ঘটনার খবর পেয়ে সোমবার রাত তিনটায় বাসায় আসেন। পরে মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে বোন ও দুলাভাই তাকে বাসার চাবি দিয়ে চলে যান। যাবার সময় বোন তাকে বলেন, ‘আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি। সেখান থেকে সন্তানদের লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাবো।’ এরপর থেকে বোনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি বলে জানান ওবায়দুল।
ওবায়দুলের সঙ্গে কথা বলার সময়ই বাসাটিতে আসেন নুসরাতের গৃহ শিক্ষিকা শিউলী আক্তার। বাসায় প্রবেশ করেই তিনি যেন হতবাক। কথা হলে তিনি জানান, চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি নুসরাতকে পড়াচ্ছেন। সোমবার বিকেল তিনটার দিকে এসে তিনি নুসরাতকে পড়িয়েছেন। তবে ওই সময় ভাই-বোনের কাউকে খাবার খেতে বা ঘুমাতে দেখেননি তিনি। তিনি জানান, ঘটনার দিন বিকেল তিনটার দিকে তিনি পড়াতে বাসায় আসেন। ওই সময় দুই ভাই-বোনকে টিভির রিমোট নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে দেখেন। পরে তাকে (শিক্ষিকাকে) দেখে নুসরাত পড়তে বসে। এ সময় নুসরাতের মার সঙ্গেও পড়াশোনার বিষয়ে কথা হয়। শিক্ষিকা শিউলী আরো জানান, রোববার ছিল তার ছাত্রীর বাবা-মার বিবাহ বার্ষিকী। এ উপলক্ষে ছাত্রী হোম ওয়ার্ক তৈরি করতে পারেনি বলে তার মা জানায়। পরে তিনি সোয়া চারটার দিকে পড়ানো শেষে বাসা থেকে বের হয়ে যান। যাওয়ার সময় তিনি বাসায় একজন নারীকে নামাজ পড়তে দেখেছেন। তবে তাকে চেনেন না বলে জানান শিক্ষিকা শিউলী।
বড়িটির বাড়িওয়ালা ও আইডিয়াল স্বুল এন্ড কলেজের বনশ্রী শাখার গণিতের শিক্ষক মো. আব্দুল কাদের জানান, গত বছরের ১ আগাস্ট থেকে দুই সন্তানসহ ওই ফ্লাটে ১৯ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় ওঠেন আমানউল্লাহ ও মাহফুজা মালেক দম্পতি। বাসায় ওঠার সময় আমানউল্লাহ জানিয়েছিলেন, তিনি ইলাস্টিক (রাবার) ব্যবসায়ী। উত্তর বাড্ডায় তার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে এই সময়ের মধ্যে এই দম্পতি বা তাদের পরিবারে কোনোরকম গন্ডগোলের খবর পাননি বা শোনেননি। তিনি আরো জানান, তার স্কুলের সহকর্মী অপর শিক্ষক শফিকুল ইসলামের মাধ্যমে ওই দম্পতিকে ফ্লাটটি ভাড়া দেয়া হয়। শফিকুল আমাউল্লাহর বন্ধু।
এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে র্যাব-৩ এর কোম্পানী কমান্ডার এএসপি মোস্তাক আহমেদ জানান, সোমবার বিষক্রিয়ায় ভাই-বোনের মৃত্যু হয়েছে জানানো হলেও মঙ্গলবারের লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় পারিবারিক বিষয় ও বাহিরের অন্য কোনো ঝামেলা রয়েছে কিনা তার তদন্ত চলছে।
জামালপুরে দুই ভাই-বোনের লাশ
নিহত দুই ভাই-বোনের লাশ আজ মঙ্গলবার দুপুরে তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের উদ্দেশ্যে নেয়া হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে ঢামেক মর্গ থেকে চাচা আবুল হোসেন দুই ভাই-বোনের লাশ আ্যাম্বুলেন্সযোগে নিয়ে যান। যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের জানান, তাদের মা-বাবা মঙ্গলবার সকালে জামালপুরে চলে গেছেন। সেখানেই তাদের লাশ দাফন করার হবে।