মেয়ে শিশুদের শিক্ষা সমস্যা শুধু জাতীয় সমস্যাই নয়; এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমরা জানি যে, সমগ্র বিশ্বে ৬৫ মিলিয়ন বালিকা স্কুলে যায় না । বাংলাদেশেও এই সংখ্যা কম নয়। এই বিশাল জনগোষ্ঠিকে বাদ দিয়ে নারী ক্ষমতায়ন তথা দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
আমাদের দেশে যে সকল মেয়ে শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তাদের অধিকাংশই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পায় না। আর যারাও সুযোগ পায় তাদের সিংহভাগই ঝড়ে পড়ে। এতে যে শুধু মেয়ে শিক্ষার্থীইর ক্ষতি হচ্ছে তা নয়; বরং ক্ষতি হচ্ছে পরিবারের, সমাজ তথা দেশের। প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে মেয়েদের স্কুল গামী করা; তাকে বিদ্যালয়ে ধরে রাখা, উচ্চ শিক্ষার এবং নিজেকে সামর্থ্যবান হিসাবে গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া।
২০১১ সালের বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মেয়ে শিক্ষার হার ৫৩.৪১ ভাগ। ২০১২ সালের বেনবেইস এর তথ্য অনুযায়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের ভর্তির হার ছিল ৫৩.৬৯ ভাগ । বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী ১.৫ মিলিয়ন বালিকা স্কুলে যায় না। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এ্ই হার আরো বেশী এবং প্রতিদিন এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রাম অঞ্চলে বিশেষ করে চর, হাওড়, সমুদ্র উপকুলবর্তী এবং পাহাড়ী অঞ্চলে ্এ্ই হার খুবই বেশী।
বাংলাদেশ সরকার এই সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করেছে যেমন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী, দশম শ্রেনী পর্যন্ত বিনা মূল্যে বই বিতরন এবং মেয়েদের বৃত্তির ব্যবস্থা ইত্যাদি।
এই সকল উদ্যোগ গ্রহনের ফলে পূর্বের চেয়ে অবস্থার উন্নতি হলেও এখনো যেন মেয়েরা শক্তি সার্মথ্য নিয়ে দাড়াতে পারছে না তাদের নিজের জীবনের উদ্দেশ্যকে সফল করতে। এখনো অনেক মেয়ে আছড়ে পড়ে মূল গতি ধারা থেকে। মনে হয় এদের দেখার মত কেউ নেই, এদের কথা শুনার মত কেউ নেই। অভিভাবকগনও যেন তাদের মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ততটা যতœশীল নয় যতটা যতœশীল তাদের ছেলেদের শিক্ষার বিষয়ে। জীবন যুদ্ধে মুখ থোবরে পড়ে এই সকল মেয়েরা। ভেঙ্গে যায় তাদের সোনালি স্বপ্ন।
বিভিন্ন কারনে মেয়েরা স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ে; যেমন শুধু মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত স্কুল নেই, বাড়ী থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব বেশী, শিশু বিবাহ, স্কুলে যাওয়ার আসার পথে বখাটে ছেলেদের উৎপাত, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, লিঙ্গ ভিত্তিক বৈষম্য, অভিভাবকদের অসচেতনতা, নি¤œ মানের শিক্ষা ও পাঠদান পদ্ধতি ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা একটি বড় কারন। আমাদের দেশে ছেলে শিশুর চেয়ে মেয়ে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয় বেশী। আর সঙ্গত কারনেই অভিভাবকগন মেয়ে শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন বা চিন্তিত থাকেন । আর তাই তারা চেষ্টা করেন দ্রুত তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে চিন্তা মুক্ত হবেন বা দায়িত্ব থেকে খালাস পাবেন। অনেক অভিভাবক তাদের অনিচ্ছা সত্বেও বখাটেদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেক মেধাবী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন। এই সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার, সমাজ, নাগরিক সমাজ, পুলিশ প্রশাসনের উচিত সরকারকে এই সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে সহায়তা করা। তাহলেই আমরা আমাদের শিশুদের জন্য বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারব।
আর এই সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ কিশোরী মেয়েদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এই প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মেয়েদেরকে শেখানো হয়-
ক্স কিশোরী বয়সে মেয়েদের কি কি ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন হয়
ক্স জীবন দক্ষতার ১১টি উপাদান সম্পর্কে ধারনা দেওয়া হয়। কোন পরিস্থিতিতে কোন উপাদান কাজে লাগাতে হয।
ক্স চলার পথে কোন কোন সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং সমস্যা সমাধানে তাদের করনীয় কি?
এছাড়া আর একটি বিষয় না বললেই নয়, এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে না বলা, চলে যাওয়া এবং অন্যের সাথে শেয়ার করার পদ্ধতি সর্ম্পকে বিশদ ধারনা দেওয়া হয়। অর্থাৎ কোন সমস্যায় পড়লে কখন তারা না বলবে, কখন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলে যাবে এবং কখন তারা আপন কারো সাথে বিষয়টি শেয়ার করবে। জীবনে ঁেবচে থাকার জন্য, পথ চলার জন্য কিশোরী মেয়েদের জন্য এই প্রশিক্ষন খুবই প্রয়োজন।
শ্রীপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী ইলা বলেন, ’আমি দেখেছি আমার বড় বোনেরা কোন বিষয়ে প্রতিবাদ করতে পারত না। কেউ কিছু বললে নীরবে কাঁদত। আমার বাবা আমার বড় বোনকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। আমার মনে হত আমাকে হয়ত আমার বোনের মত মেয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে; আমি হয়ত লেখাপড়া করতে পারব না কিন্তু না জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষন গ্রহন করার পর আমার ধারনা পাল্টে গেছে। প্রশিক্ষন থেকে আমি জানতে পেরেছি কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হবে, কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে, কি ধরনের আচরন করতে হবে। এখন আমি প্রতিবাদ করার ভাষা জানি। আমার বাবা আমাকে ততটা চিন্তা করেন না যতটা করত আমার বড় বোনকে নিয়ে। আমি এখন মনোযোগ সহকারে পড়ছি।
পরিবার তথা মা বাবা, ভাই বোনদের এই বিষয়গুলি সর্ম্পকে সচেতন হতে হবে যাতে মেয়ে শিশুরা এই প্রশিক্ষন গ্রহন করতে পারে। নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য মেয়েদেরকেও এই সকল বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
এছাড়াও প্ল্যান মেয়েদের আত্ম রক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কারাতে প্রশিক্ষণ প্রদানে সহায়তা করে আসছে। সমগ্র বাংলাদেশ ব্যাপী এই প্রশিক্ষণ চলমান আছে তার মধ্যে গাজীপুর জেলা অন্যতম। গাজীপুর জেলায় প্ল্যান প্রথমে ১০টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই কার্যক্রম শুরু করলেও পরে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় জেলার মোট ২১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই প্রশিক্ষন চলমান আছে। এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোট ৮৪০ জন মেয়ে শিক্ষার্থী এই প্রশিক্ষন গ্রহন করেছে। এতে করে মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, তারা নিজেদেরকে সুরক্ষিত মনে করছে, তারা এখন প্রতিবাদ করতে পারে এবং স্কুলের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়ছে।
প্ল্যান শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিত করার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিদ্যালয় ভিত্তিক বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রনয়নে সহায়তা করে আসছে। ছাত্র ছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি তাদের মতামত প্রদান করে এবং বিদ্যালয়ের বিরাজমান সকল সমস্যা তুলে ধরে। তারপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই সকল সমস্যা চিহ্নিত করার মাধ্যমে পরিকল্পনা প্রনয়ন করে নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন করে নেয়। সুষ্ঠ মনিটরিং এর মাধ্যমে এই পরিকল্পনার অগ্রগতি যাচাই করা হয়। এছ্ড়াা নিদিষ্ট সময় পর পর এই পরিকল্পনার মূল্যায়ন করে।
এতে করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ও পাশের হার বেড়েছে। শিক্ষক, অভিভাবক তথা এলাকাবাসী এই ফলাফলে খুবই সন্তোষ্ট। বিশেষ করে অভিভাবকগন তাদের মেয়ে শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী।
প্রত্যেকটা স্কুলে যদি এই ধরনের বিদ্যালয় ভিত্তিক বার্ষিক স্কুল উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন করা হয় তাহলে গুনগত মানের শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতি অর্জন সম্ভব।
এই সকল উদ্যোগের ফলে মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়ছে। আর যখনই মেয়ে শিক্ষার হার বাড়বে তখনই সমাজ থেকে দূর হবে শিশু বিবাহ নামক সামাজিক ব্যাধী। তাই আসুন, আর দেরী না করে আমাদের কন্যা শিশুকে স্কুলে পাঠাই তাকে শিক্ষিত করে শিশু বিবাহ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলি – এই হোক আমাদের আগামী দিনের প্রত্যয়।
কমিউনিকেশনস কোর্ডিনেটর
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ