গতকাল সোমবার শেষ দিনের মেলা শুরু হয় দুপুর ১টায়। রোদ ছিল, কিন্তু বইপ্রেমীদের স্পর্শ করেনি তা। রাত ৮টায় মেলার আলো নিভে যাওয়ার সময়েও ছিলেন তারা। মেলার দুই প্রাঙ্গণ বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আলো নিভলেও আশপাশে চায়ের দোকান আর রাস্তার ধারে কিংবা শাহবাগে এসে আড্ডা দিয়েছেন লেখক-পাঠকরা।
প্রকাশকরা ব্যস্ত ছিলেন শেষ মুহূর্তের হিসাব-নিকাশ আর দ্রুত স্টল অপসারণের ব্যবস্থা নিয়ে। কেমন হলো এবারের মেলা? এ প্রশ্নের জবাবে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, ‘আমি সন্তুষ্ট। আমার মনে হয়, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে টুকটাক সমস্যা ছাড়া ভালোভাবেই শেষ হয়েছে এবারের বইমেলা। এ বছরের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীবারের মেলা আরও ভালোভাবে করা যাবে।’
মেলার প্রতিবেদনে জানানো হয়, এবারে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমি বিক্রি করেছে এক কোটি ৩৯ লাখ ৬৩ হাজার ৪৫৮ টাকার বই। একাডেমির কাছে দেওয়া প্রকাশকদের হিসাবমতে, বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা বিক্রি করেছে ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই। তবে প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নানা কারণে তারা একাডেমিকে সঠিক পরিসংখ্যান দেন না। তাদের হিসাবমতে, এবার বিক্রি হয়েছে ৫০ কোটি টাকার বেশি।
মেলার সাত সীমাবদ্ধতা: বাংলা একাডেমির প্রতিবেদনে এবারের মেলার সাতটি সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেছেন মেলার সদস্য সচিব জালাল আহমেদ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- গুচ্ছগুলো দৃশ্যমান ছিল না, নতুন প্রবেশপথ হলেও সেটা দৃষ্টিনন্দন হয়নি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের উত্তর-পূর্ব অংশে ক্রেতাসমাবেশ ঘটেনি, গুচ্ছের চারপাশে পাকা রাস্তা করা হয়নি, তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পর্যাপ্ত ছিল না, পূর্ব দিকে পাকা ও পরিচ্ছন্ন শৌচাগার ছিল না। এ ছাড়া দর্শনার্থীদের পানীয় ও খাবারের সংকটের কথাও অকপটে স্বীকার করেন তিনি। আগামীবার এ বিষয়ে বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আশা করেন একাডেমির এ পরিচালক।
বই প্রকাশ: এবারের বইমেলায় প্রকাশ হয়েছে তিন হাজার ৪৪৪টি নতুন বই। গতবারের বইমেলায় এসেছিল তিন হাজার ৭০০টি। সে হিসাবে গতবারের তুলনায় এবার ২৫৬টি বই কম এসেছে। এ বছর কবিতার বই এসেছে সর্বোচ্চ ৯৩৯টি। এ ছাড়া উপন্যাস ৫২৯টি, গল্প ৫০৩টি, প্রবন্ধ ১৯৭টি, ছড়া ১২২টি, গবেষণা ৪৫টি, শিশুতোষ ১৬২টি, জীবনী ৮১টি, ভ্রমণকাহিনী ৫৪টি, বিজ্ঞান ৫৩টি, ইতিহাস ৪৮টি, মুক্তিযুদ্ধ ১০১টি, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ৪৫টি, ধর্মীয় ৩২টি, নাটক ১২টি, কম্পিউটার ৯টি, অনুবাদের বই ২৫টি, রাজনীতি ১৫টি, চিকিৎসা ২৫টি, রম্য ১৮টি, রচনাবলি ১২টি ও অভিধান ৬টি এবং অন্যান্য বিষয়ের বই এসেছে ৪২১টি।
আনন্দ আলো শিশুসাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা: বইমেলার শেষ দিনে গতকাল ঘোষণা করা হয়েছে এসিআই ফান কেক-আনন্দ আলো শিশুসাহিত্য পুরস্কার। শিশুসাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় আলী ইমাম (বাঘ ও ব্যাঙের গল্প), আনিসুল হক (গুড্ডু বুড়ার হাসির কাণ্ড গুড্ডু বুড়ার দারুণ কীর্তি), পলাশ মাহবুব (মা করেছে বারণ) ও মামুন সারওয়ার (দশে দশে একশ ছড়া) এ পুরস্কার পান। পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
মেলামঞ্চের আয়োজন: গতকাল মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘নওয়াজেশ আহমেদ ও নাইবুদ্দিন আহমদকে স্মরণ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিল্প-সমালোচক নজরুল ইসলাম। আলোচনায় অংশ নেন বুলবন ওসমান, শামসুল আলম ও নাসিম আহমেদ নাদভী। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
সমাপনী অনুষ্ঠান: গতকাল সন্ধ্যায় মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে এতে বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি সচিব আক্তারী মমতাজ ও একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। মেলার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সদস্য সচিব জালাল আহমেদ।
অনুষ্ঠানে ফ্রাঁস ভট্টাচার্য ও মন্জু ইসলামকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার, মাওলা ব্রাদার্সকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার, ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশের মূলানুগ পাঠ- ভূমিকা ও কবিতা গ্রন্থের জন্য বেঙ্গল পাবলিকেশনস্, বুলবুল আহমেদ সম্পাদিত ‘বুড্ডিস্ট হেরিটেজ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থের জন্য নিমফিয়া পাবলিকেশন ও শেখ তাসলিমা মুন রচিত ‘আমি একটি বাজপাখিকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম’ গ্রন্থের জন্য পাঠসূত্রকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, বিভিন্ন শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ময়ূরপঙ্খিকে রোকনুুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সময় প্রকাশন, মধ্যমা পাবলিকেশন ও জ্যার্নিম্যান বুকসকে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার-২০১৬ দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী ফরিদা পারভীন।