মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন করেছিলেন এ দেশটাকে একটি রক্তক্ষয়ী আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, যে আন্দোলনের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ এবং দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথের যুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। আজ বাঙালি জাতির গৌরব ও অহঙ্কারের মাস অগি্নঝরা মার্চের সূচনা দিন।
আজ থেকে ৪৫ বছর আগে ১৯৭১ সালের এ মার্চেই ডাক এসেছিল বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেওয়ার চূড়ান্ত সংগ্রামে।
কেমন ছিল সে সংগ্রাম, কেমন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণার সেই ক্ষণটি; লিখেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ- “শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/ সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর-কবিতাখানি :’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’/ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।”
মূলত ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বাঙালির ধারাবাহিক স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ ধাপের প্রতিরোধের শুরু। এই দিন দুপুর ১টায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খান আকস্মিক এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন। ইয়াহিয়ার এই ঘোষণা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গোটা জনপদকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। বিক্ষোভে ফেটে পড়েন রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সর্বস্তরের মানুষ। ছাত্র, শিক্ষক, আইনজীবী, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, কল-কারখানার শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ নেমে আসেন রাস্তায়। বিক্ষুব্ধ হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতে শুরু করেন ঢাকার মতিঝিলের হোটেল পূর্বাণীর সামনে। সেখানে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের বৈঠকে বসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চূড়ান্ত সংগ্রামের ঘোষণার অধীর অপেক্ষায় উন্মুখ স্বাধীনতাকামী বিক্ষুব্ধ মানুষের মুখে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’- এই স্লোগান আগের চেয়ে আরও দৃঢ়ভাবে উচ্চারিত হতে শুরু করে।
এক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিমা সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়ে। প্রকৃত কর্তৃত্ব চলে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষিত হয়- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে আরও সুনির্দিষ্টভাবে এগিয়ে নিয়ে যায় জাতিকে।
আরেকদিকে তখন রচিত হচ্ছিল বাঙালি নিধন আর তাদের চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার নীল-নকশা। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ২৫ মার্চ কালরাতে পৃথিবীর ইতিহাসের ঘৃণ্যতম ও বর্বরোচিত গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণহত্যার মধ্যরাতেই তথা ২৬ মাচের্র প্রথম প্রহরে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর হাতে গ্রেফতারের আগমুহূর্তে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ডাকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি। সশস্ত্র প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বিশ্ব-মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করে বাংলাদেশ।
অগি্নঝরা মার্চকে বরণ করে নিতে দেশজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দল ও সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত এসব কর্মসূচিতে জাতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জনকারী সূর্যসন্তানদের। বেশ কয়েকটি সংগঠনের মাসব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সূচনাও ঘটবে আজ। মার্চের প্রথম প্রহর সোমবার রাত ১২টা ১ মিনিটে কয়েকটি সংগঠন আলোকশিখা প্রজ্বালনের মধ্য দিয়ে শুরু করেছে মাসব্যাপী কর্মসূচি।