———-শাহান সাহাবুদ্দিন
আমরা দেবতা নই। তুমি ও কি ছিলে?
ভুুল- সেতো করে মানুষেই।
অপার ক্ষমার ভুলে যেই মাশুল দিলে
তার দায় আমাদের শুধতে হবেই।
মুজিবের এপিটাফ/ হায়াৎ মামুদ
তোমার শাহাদৎ আঙ্গুলের ঠিক মাথায় আমি একটি লাল সবুজের উজ্জল পতাকা দেখতে পেলাম, দেখতে পেলাম তোমার বুকের জমিন ৫৬ হাজার বর্গমাইলকে ধারণ করলো, দেখতে পেলাম তোমার দু’চোখে আবহমান বাংলার শাশ্বত নিসর্গ- অপরুপ দৃশ্যপট। তোমার শার্দূল মুখচ্ছবিতে ষ্পষ্ট দেখলাম তোমার স্বপ্ন ও আকাংখার সমান বড় আগামী দিন- আগামী বাংলাদেশের ছবি। তুমি তখনো অবিচল কিংবদন্তি, একজন জ্যোতির্ময় মানুষ, উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং অসম সাহসী বাঙালির একমাত্র মহত্তম ইতিহাস! হিন্দু-মুসলিম, জাতি-উপজাতি বলে বিভেদের পাহাড় ভেঙ্গে দিলে তুমি মানবতাবাদের অপার আকাশ মাথায় নিয়ে। তোমার কন্ঠস্বর তখন তোমাকে ছাপিয়ে হয়ে উঠলো মুণি ঋষিদের কোমল কন্ঠস্বর। বিভেদের পাহাড়ে জন্ম নিলো ¯্রােতস্বিনী নদী, সে নদীতে ¯œান সেরে বাঙালি যথার্থই বাঙালি হলো।
তখনো তুমি অগ্নি বলয়ের ভেতরে। তখনো তুমি ভিসুবিয়াসের একেবারে কাছাকাছি। সেখানে দাঁড়িয়েই তর্জনীর ইঙ্গিতে বাতলে দিলে আমাদের পথ, যে পথে শেষ হবে দাসত্বের কাল, যে পথে অপেক্ষমাণ আগামীর সকাল। আমরা ও গাইলাম তোমার থেকে শেখা শেকল ভাঙার গান।
১৭৫৭ থেকে ১৯৭১ কতদূর, সে নিয়ে বিস্তর ঘাটাঘাটি করবে ইতহাসবেত্তাগণ। আমি শুধু বলে যেতে চাই আজকের বাংলাদশের, আজকের পৃথিবীর অগ্নিপুত্রদের কাছে একজন প্রত্যয়দীপ্ত দৃঢ়চেতা পুরুষের কথা, যার আপাদমস্তকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে দিগি¦জয়ী সম্্রাটের উজ্জ্বলতা, যার ধ্বমণীর রক্ত¯্রােতে সদা ধাবমান পদ্মা মেঘনা যমুনা, যার উদাত্ত কন্ঠস্বরে কেঁপে ওঠে আকাশ- বাতাস দশ দিক; যিনি হয়ে উঠেছিলেন কোটি বাঙালির একজন। ৬৬, ৬৯ ও ১৯৭১ এর মতো সংবেদনশীল ও আগুন ঝরা সময়ে হয়ে উঠেছিলেন অনন্য একজন, সেই ইতিহাস মহানায়কের কথা!
প্রিয় প্রমিথিউস, তুমি কি ঘুমাওনি কৈশোরোত্তর কালে? দু’দন্ড শান্তি নিয়ে আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলার ফুরসত পাওনি কখনো? না কী ধর্মপাল, মহিপাল, তিতুমীর, হাজী শরীয়ত, শমসের গাজী, ঈসা খাঁ ও সূর্যসেনের রক্ত শরীরে ধারণ করে নিজেই হয়ে গিয়েছিলে আশ্চর্য সংগ্রামী ইতিহাস, রাজপথকে বেছে নিয়েছিলে সাবলীল বেঁচে থাকার পথ হিসেবে?
০২.
অদৃশ্যের পরপারে এই সময়ে তুমি কি করছো কি ভাবছো বস্তুত আমি জানিনা। শুধু জানি ইতিহাসের দীর্ঘ পথ ধরে হেঁটে যখন তোমার জাতির দাসত্ত্বের কাল শেষ হলো তোমার ইস্পাত দৃঢ় মনোবল হিমালয়ের মতো অটুট ব্যক্তিত্ত্ব আর দুপুরের জ্বলজ্বলে সূর্য্যরে মতো প্রজ্ঞাকে পুঁজি করে, যখন লিংকন গ্রেট ম্যান্ডেলা হুচি মিন দের পথ ধরে গোটা প্রথিবীতে ছড়িয়ে দিলে মহত্ত্বম বিপ্লবের অবিনাশি গান, যখন তোমার শাহাদৎ অঙ্গুলির ইঙ্গিতে ও বজ্র নিনাদ কন্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়লো হিমালয় থেকে সুন্দর বন, টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায়; যখন তোমার শালপ্রাংশু দেহের নির্ভীক দীর্ঘতর ছায়া ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের বাংলাকে পতাকার ন্যায় পরম স্নেহে ও ভালোবাসায় আগলে রাখলো, যখন তুমি মহাকবির মতো বাতাসে স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়ে উচ্চারণ করলে ‘ তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক…প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুল..’‘মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব,তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্…’; তখন পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ধলেশ্বরী-বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-সুরমা-কুশিয়ারা-কর্ণফুলি-আড়িয়াল খাঁর জল উঠলো ফুঁসে, হিমালয় ও কেঁপে উঠলো খানিকটা; ঈস্রাফিলের শিঙ্গার ফুঁক শুনে যেন জেগে উঠলাম আমরা, তারপর যার যা কিছু ছিলো- হৃৎপিন্ড, বিপুল সাহসিকতা, আত্ববিশ্বাস আর হৃদয়ে লালন করা তোমার হতে পাওয়া প্রবল দেশপ্রেম তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করলাম, পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সেনানীদের হারালাম, পরাস্ত করলাম লাখো লাখো পাক জানোয়ার তথা নেড়ি কুকুরদের; বাংলার মাটিতে পতপত করে উড়তে থাকলো হায়েনাদের কবল থেকে মুক্ত করা লাল সবুজের উজ্জ্বল পতাকা; বাঙালির চোখে তখন অপার স্বপ্ন, বাঙালি তখন তোমার উদ্দেশে নিবেদন করছে যথার্থই তোমার যতোটুকু পাওনা-‘ইস্পাত গড়া শানিত সূর্যের মতো/ অভিশপ্ত বাংলার যন্ত্রনার অন্ধকার ফুঁড়ে/ তুমি বেরিয়ে এলে মুজিবর/ তোমার জ্বলন্ত আবির্ভাবের আলোয়/ আমরা স্তম্ভিত।’ কিন্তু হায়, যুদ্ধত্তোর কালে এ তুমি কি করলে প্রিয় প্রমিথিউস? কিউবার মহান বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে তোমাদের একান্ত বৈঠকে যখন বললেন-‘আইনজীবী, সাংবাদিক,ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা,চিকিৎসক,প্রকৌশলী,শিক্ষাবিদ-এসব পেশাজীবীকে সরকারী প্রশাসনে সম্পৃক্ত করুন। এরা ভুল করবে, এক সময় সঠিক শিক্ষা ও গ্রহণ করবে। কিন্তু এরা ষড়যন্ত্র করবেনা। মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব দিন।’ তিনি তোমাকে দৃঢ়তার সঙ্গেই জানিয়েছিলেন-‘পৃথিবীর কোথাও পরাজিত প্রশাসনের পদস্থদের নতুন প্রশাসনে দায়িত্ব দেয়া হয়না।’ এক্ষেত্রে তিনি তোমাকে উদাহরণ হিসেবে কিউবার মহান বিপ্লবের পর কমরেড চেগুয়েভারা যিনি কিউবার পরাজিত প্রশাসনকে সমূলে উৎপাটন করে কিউবা প্রশাসনকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন তাও জানালেন। এমনকি চিনের মাও সে তুং, কম্পুচিয়ার বিপ্লবী সরকার ও এই কাজটিই করেছিলেন। সবশেষে তিনি তোমার দরিয়ার সমান বড় ও সরল হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে কমরেড আলেন্দের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন-‘ইউ আর অলসো গোয়িং টু বি ফিনিসড কমরেড মুজিব!’ ইতিহাসের মহানায়ক মহাপ্রাণ বঙ্গবন্ধ,ু ক্যাস্ট্রোর কথাগুলো হয়তো তোমাকে ঐ ভাবে নাড়া দেয়নি, আর দিবেইবা কি করে? তুমি নিজেইতো এক বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলে-তোমার শক্তি ও দূর্বলতা হচ্ছে দেশের মানুষকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসা। এইক্ষণে আমার মনে পড়ছে কালোত্তীর্ণ কথাশিল্পী শওকত ওসমানের অনবদ্য এ পঙতিগুলো-‘ুইতিহাস নয়/ অদৃশ্যের পরিহাস,/ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,/ তোমার ঘাতকেরা আজ নিজেদের সেবক রুপে জাহির করে।’…শেক্সপিয়রের ’ জুলিয়াস সিজার‘ নাটকে সিজার-হত্যার পর মার্ক অ্যান্টনির উক্তিটিও মনে পড়ছে আমার-‘এই এক শোকাতুর রোম, বিপজ্জনক রোম।’ স্বাধীনতা উত্তরকালে জুলিয়াস সিজারের রোম আর গোটা বাংলা যেন সমার্থক হয়ে উঠেছিল; অদ্ভুত আঁধার এক এসেছিল তোমার সময়ে, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি চোখে দেখেছিল তারা; যাদের হৃদয়ে প্রেম- প্রীতি নেই সেই তাদের পরামর্শ ছাড়া তোমার রাষ্ট্রীয় প্রশাসন অচল হয়ে পড়েছিল; মহৎ প্রাণ জাতির পিতা, সেই হিতাকাঙ্খী রুপি তোষামুদে সেবকদের কারণে তুমি ঠিক বুঝে উঠতে পারোনি তোমাকে ঘিরে কিভাবে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলছিল, বাংলাকে বানানো হচ্ছিল কাশিম বাজার কুঠি, তোমার অনুরাগী অপগ্রহেরা কিভাবে একে একে রিহার্সেল সেরে নিচ্ছিল ঘসেটি বেগমের অন্দর মহলের ষড়যন্ত্রের নাটকের, সকলেই পড়ে নিচ্ছিল মীর জাফর মোহাম্মদী বেগ ও রায়দূর্লভের পোশাক; সেই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে গেলে তুমি,ব্যর্থ হলে মোহন লাল ও মীর জাফরের মধ্যকার পার্থক্যটা বুঝে উঠতে; অপগ্রহরা অষ্ট প্রহর বিষ ঢালতে থাকলো তোমার কানে, অবশেষে বাংলার দ্বিতীয় মোহন লাল, যিনি এক পোশাকে দীর্ঘ নয় মাস বীরত্ব ও মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে সফলতার সঙ্গে তোমার দায়িত্ব পালন করে গিয়েছিেিলন, সেই বঙ্গ তাজ তাজউদ্দিন আহমেদকে সুকৌশলে তোমার পাশ থেকে সরিয়ে দিয়ে ষড়যন্ত্রের প্রথম সফলতার পর্বটি শেষ করলো । আর দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত পর্বের সমাপ্তী ঘটলো ১৫ আগষ্ট,১৯৭৫- এ। ওসমান (রা.), দ্বিতীয় নিকোলা, সিরাজউদ্দৌলা, লিঙ্কন, কেনেডি, মহাত্মা গান্ধী,ইন্দিরা গান্ধী,বন্দর নায়েক, প্রেমাদাসা, আনোয়ার সাদাত, আলেন্দে, জিয়াউল হক ও পুয়েতারার মতো অসময়ে অশুভ শক্তির হাতে বাংলার আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বলতর নক্ষত্রের শোক স্তব্দ বিদায়ের পর। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাদ্দৌলা ও ফ্রান্সের বীর কৃষককন্যা জোয়ান অব আর্ক আর তোমার নিয়তি ও জীবন আখ্যান যেন একই ইপিসোড ও সুতোয় গেঁথে রেখেছিলেন মহান ইতিহাস নির্মাতা।
বাঙালির সর্বকালের মহানায়ক, আজ শান্ত¡না এইটুকু- যেসব নেকড়ের কারণে বাংলার মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ, যেসব হায়েনার কারণে এ পরিশুদ্ধ মাটিতে মৃত্যুর নগ্ন নৃত্য দেখি, ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি তন্দ্রার ভেতরে, যেসব দুষ্ট গ্রহের কারণে ৭১-এর দুঃস্বপ্নের রাত আর রক্তাক্ত সময়কে ভুলতে পারছেনা বয়সের ভারে আক্রান্ত কালের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা, যেসব পুরনো শকুনেরা দীর্ঘকাল খামচে ধরেছিল জাতির পতাকা, সেইসব শকুনদের এই বাংলার মাটিতেই বিচার হচ্ছে তোমার যোগ্যতম উত্তরসূরীর নেতৃত্বে, এবং তোমার ঘাতকদের ও দিয়ে দেয়া হয়েছে ও হচ্ছে তাদের যথাযথ পাওনাটুকু। কিন্তু গভীর শংকা ও উৎকণ্ঠা নিয়ে ভাবছি,তোমার সময়ের মোসাহেবদের উত্তরসূরীরা তোমার কন্যা প্রধান মন্ত্রি শেখ হাসিনাকে ভুল পথে প্রভাবিত করছে নাতো?
লেখক : কবি, গল্পকার ও সাংবাদিক