ঢাকা : কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণার পর থেকে তা বানচাল করার পরিকল্পনা হচ্ছে বলে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও ভেন্যু সমস্যার সমাধানে এবার সরকারি দল আওয়ামী লীগের দ্বারস্থ হতে যাচ্ছে বিএনপি! তবে দলের নেতারা এ বিষয়টিকে উড়িয়ে দিলেও চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় সূত্রের দাবি, দলে এমন আলোচনা চলছে।
সূত্র বলছে, কাউন্সিলের এক মাসেরও কম সময় বাকি, অথচ এখনো পর্যন্ত ভেন্যু নির্ধারণ হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে ভেন্যু সমস্যার সমাধানে সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যাপারে বিএনপিতে আলোচনা চলছে। দুই-একদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজে অথবা দলটির পক্ষে অন্য কেউ কিংবা কোনো প্রতিনিধি দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ-দু’জনেই বিষয়টি অস্বীকার করেন। এ ধরনের কোনো বিষয় সম্পর্কে তারা অবগত নন বলেও জানিয়েছেন।
আগামী ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল ও সম্মেলন করবে বিএনপি। গত ২৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ওই সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকেই কাউন্সিলের ভেন্যু হিসেবে তিনটি স্থানকে (বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন) নির্বাচন করা হয়। বৈঠকের দুই-একদিনের মধ্যেই কাউন্সিলের ভেন্যু হিসেবে ওই তিনটি স্থানের অনুমতি চেয়ে ডিএমপিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে বিএনপি। কিন্তু কাউন্সিলের মাত্র ২১ দিন বাকি থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনোটির ব্যাপারেই সরকারি অনুমতি পাওয়া যায়নি।
অবশ্য গত ১০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কাউন্সিলের ভেন্যু হিসেবে এই তিনটি স্থানের বাইরে বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়। কিন্তু সেখানেও অনুমতি পায়নি তারা। ভেন্যু নির্ধারিত না হওয়ায় প্রচারসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে বিএনপি।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান বলেন, ‘কাউন্সিলের ভেন্যু হিসেবে তিনটি স্থান চেয়ে আমরা ডিএমপিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জানুয়ারি মাসেই আবেদন করেছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনুমতি পাইনি। এতে প্রচার-প্রচারণাসহ অনেক বিষয়ে বিঘ্ন ঘটছে। আশা করি, সরকার গণতন্ত্রের স্বার্থে অতিদ্রুত আমাদেরকে কাউন্সিলের ভেন্যুর অনুমতি দেবে।’
সূত্র মতে, বিএনপি এখনো বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রেই কাউন্সিল করার ব্যাপারে আশাবাদী। তারা মনে করছে, সরকার শেষ মুহূর্তে তাদেরকে সেখানে কাউন্সিলের অনুমতি দেবে। গণপূর্ত বিভাগ সম্প্রতি বিএনপিকে বলেছে, সোহরাওয়ার্দীতে তাদের আপত্তি নেই। তবে সেক্ষেত্রে ডিএমপির অনুমতি লাগবে। দলটি শেষ ভরসা হিসেবে সোহরাওয়ার্দী ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনকে বিবেচনা করছে। ডিএমপির অনুমতি সাপেক্ষে কাউন্সিলের পর্বটি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে করবে বিএনপি।
এদিকে, ভেন্যু নির্ধারিত না হলেও বিএনপির আগামী ১৯ মার্চের জাতীয় সম্মেলন ও কাউন্সিলকে ঘিরে পুরোদমে কাজ চলছে। কাউন্সিল সফলে একটি প্রস্তুতি কমিটির পাশাপাশি ১২টি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়াকে চেয়ারপারসন করে ওই প্রস্তুতি কমিটি (জাতীয় কাউন্সিল ও সম্মেলন-২০১৬ প্রস্তুতি কমিটি) গঠন করা হয়। সকল উপ-কমিটির আহ্বায়করা ওই কমিটির সদস্য হবেন। এসব কমিটিগুলোও পুরোদমে কাজ শুরু করেছে।
এছাড়া সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সদস্যদের সুপারিশক্রমে দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধন করে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের জন্য কমিশন গঠন করা হয়। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারকে প্রধান করে গঠন করা হয় তিন সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিশন। কাউন্সিলে এই দুইপদে নির্বাচন হবে।
তবে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন বলে আশা নেতাকর্মীদের। তারা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেও কাউন্সিলেই আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নাম ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে। অবশ্য তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কমিশন তা করেনি। সাধারণত কাউন্সিলের দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে এ তফসিল ঘোষণা করা হয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘যথাসময়ে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে। তখন গণমাধ্যমকে এ ব্যাপারে জানানো হবে।’
এদিকে, কাউন্সিল উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের আমন্ত্রণ জানাবে বিএনপি। এ লক্ষ্যে সাংবাদিক শফিক রেহমানকে আহ্বায়ক করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শফিক রেহমান বলেন, ‘আগামী সপ্তাহে বৈঠকের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কমিটি কাজ শুরু করবে। কাউন্সিলে কোন কোন দেশের রাজনীতিবিদদের আমন্ত্রণ জানানো হবে, ওই বৈঠকেই সেটি আলোচিত হবে। তবে সার্কভুক্ত দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী দেশগুলোকেও (সকল মহাদেশ) আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে।’
বিএনপির কাউন্সিলের জন্য শতকরা ৯০ ভাগ কাউন্সিলরদের তালিকা ইতোমধ্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে। সারাদেশে দলটির প্রায় তিন হাজার কাউন্সিলর রয়েছেন। এছাড়া পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের পর থেকে এ পর্যন্ত নিহত এবং বিএনপির বিগত আন্দোলন-সংগ্রামগুলোতে নিহত নেতাকর্মীদের জন্য কাউন্সিলে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। এ লক্ষ্যে বিএনপির নেতাকর্মীদের মৃত্যু তালিকা প্রস্তুতির কাজ শতকরা ৬০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে।
কাউন্সিলের প্রচারের জন্যও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে দলটি। এ প্রসঙ্গে রিজভী আহমেদ বলেন, ‘প্রচার ও ব্যবস্থাপনা উপ-কমিটির প্রস্তাব সম্পন্ন প্রায়। শুধু স্থানের অনুমতির অপেক্ষা। প্রচারের জন্য অন্য মাধ্যমের সঙ্গে ইন্টারনেট ও ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়াকেও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হবে।’
এদিকে কাউন্সিল উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাকে ‘বর্ণিল সাজে সাজাতে’ চায় বিএনপি। মহানগরীতে প্রচার-প্রচারণার জন্য সড়ক-মহাসড়কের বিভাজক, লাইটপোস্ট ও সড়কদ্বীপে ফেস্টুন টাঙানোর পরিকল্পনা করছে দলটি। সাজ-সজ্জার জন্য ইতোমধ্যে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে অনুমতিও চেয়েছে দলটি। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বিএনপিকে এখনো কিছু জানানো হয়নি বলে জানিয়েছেন দলটির সহ-দপ্তর সম্পাদক আসাদুল করিম শাহীন।
বিএনপির সর্বশেষ পঞ্চম কাউন্সিল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে হয়েছিল ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। তিন বছর পর পর কাউন্সিল অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও ছয় বছরের বেশি সময় পর দলটির ষষ্ঠ কাউন্সিল হতে যাচ্ছে। সর্বশেষ কাউন্সিলে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন আসেনি, ১৯৮৩ সাল থেকে দলটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করছেন খালেদা জিয়া। ১৯৮১ সালে স্বামী জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর রাজনীতিতে আসেন তিনি।
ওই সম্মেলনে মহাসচিবের দায়িত্ব পান খন্দকার দেলাওয়ার হোসেন। ২০১১ সালে তার মৃত্যুর পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করা হয়। এরপর থেকেই তিনি এই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের আশা, দলের প্রতি মির্জা ফখরুলের ত্যাগ বিবেচনায় আসন্ন কাউন্সিলে তাকে ভারমুক্ত করে ‘পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব’ করা হবে।