চট্টগ্রামে অনেক ব্যবসায়ীর সম্পদ নিলামে

Slider জাতীয়
untitled-9_193955
ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় চট্টগ্রামে একের পর এক ব্যবসায়ীর জামানত রাখা সম্পত্তি নিলামে উঠছে। কারও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কারও জায়গা-জমি কিংবা বসতবাড়ি বিক্রির জন্য নিলামে তুলছে বিভিন্ন ব্যাংক। সর্বশেষ ১১ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিলামে তোলা হয় সীতাকুণ্ডের ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন কুসুমের দুটি প্রতিষ্ঠান। এর আগে সম্পত্তি নিলামে তোলা হয় নূরজাহান গ্রুপ, ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল, ইয়াছির এন্টারপ্রাইজ, সিদ্দিক ট্রেডার্সসহ বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের।

খেলাপি হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় অব্যাহত লোকসান, জাহাজভাঙা শিল্পে মন্দা, ব্যবসায়িক প্রতারণাসহ নানা কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে পারছেন না তারা। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেউ বিনিয়োগ করেছেন শেয়ারবাজারে, কেউ বা কিনেছেন জমি। ব্যবসার জন্য ঋণ নিয়ে এভাবে অনুৎপাদনশীল খাতে টাকা আটকে রেখে তারা ব্যাংকের কিস্তি দিচ্ছেন না। পাশাপাশি যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই না করে অনেক ব্যাংক ঋণ দিয়েছে শুধু পরিচয়ের ভিত্তিতে। একই জামানত দিয়ে কেউ কেউ ঋণ নিয়েছেন একাধিক ব্যাংক থেকে। সম্পত্তি নিলামে তুলতে গিয়ে এসব অব্যবস্থাপনা উঠে আসছে। ব্যাংক এশিয়া চট্টগ্রামের আঞ্চলিক প্রধান মো. রোসাঙ্গীর বলেন, ‘কিছু ব্যাংক কাগজপত্র যথাযথভাবে

যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দিয়েছে ব্যবসায়ীদের। তাদের প্রতিটি শাখার ম্যানেজারকে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। তার পরও দু-একটি শাখা ভুল করেছে।

ব্যাংক এশিয়ার ভাটিয়ারী শাখা থেকে ১০৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারছেন না শিপব্রেকিং ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন কুসুম। একই ব্যক্তিকে আড়াই কোটি টাকা ঋণ দিয়ে এখন আফসোস করছে ভাটিয়ারীর যমুনা ব্যাংক শাখা। গিয়াসউদ্দিনের কাছে বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যক্তির পাওনা রয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

যমুনা ব্যাংক ভাটিয়ারী শাখার ম্যানেজার ইয়াছিন সিদ্দিকী সমকালকে বলেন, ‘ঋণ দেওয়ার সময় তারা কাগজপত্র যথাসম্ভব যাচাই-বাছাই করেন। কিন্তু কিছু গ্রাহক ব্যস্ততার অজুহাত তুলে সময় দিতে চান না। তখন কিছু ভুল হয়ে যায়। ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন কুসুমের কাছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা পাওনা আছে। তার সঙ্গে এখন কোনো যোগাযোগও নেই। তবে তার বাড়িটি জামানত হিসেবে আছে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, গিয়াসউদ্দিন কুসুমের বাড়িঘরসহ জামানত রাখা সম্পত্তি নিলামে ওঠাচ্ছে বিভিন্ন ব্যাংক। ব্যাংক এশিয়ায় তার খেলাপি ঋণ ১০২ কোটি টাকা। তার প্রতিষ্ঠান শাহ আমানত আয়রন মার্টের বিপরীতে ব্যাংক এশিয়া থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে মাস কয়েক আগে তার ১৭১ শতক জায়গা নিলামে তুলেছে ব্যাংক এশিয়া। আল মদিনা এন্টারপ্রাইজের বিপরীতে নেওয়া ঋণের বিপরীতে তার শিপব্রেকিং ইয়ার্ডটি নিলামে তোলার প্রক্রিয়া করছে একই ব্যাংক। এই ইয়ার্ডে এখনও একটি স্ক্র্যাপ জাহাজ থাকায় ইয়ার্ডটি নিলামে তুলতে একটু সময় নেওয়া হচ্ছে বলে জানান ব্যাংকের ম্যানেজার মিজানুর রহমান। সমকালকে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ী কুসুমের ইয়ার্ডে এখনও একটি জাহাজ আছে। এটি নিয়ে হাইকোর্টে মামলাও আছে। তবে তার ইয়ার্ড নিলামে তুলতে আদালতের রায় আছে তাদের পক্ষে। তাই জাহাজটির দফারফা করে ইয়ার্ডটি নিলামে তুলবেন তারা।’ যমুনা ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে কুসুমের বাড়ির জামানত রাখা আছে। বাড়ি নিলামে তুলে তাদের পাওনা উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করেছে ব্যাংকটি।

তবে মোবাইল ফোন বন্ধ করে আত্মগোপনে থাকায় ব্যবসায়ী কুসুমের সঙ্গে এখন আর যোগাযোগ করতে পারছে না কোনো ব্যাংকই। আমাদের সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি এম সেকান্দার হোসাইন জানান, সর্বশেষ ১১ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় একটি দৈনিকের দশম পৃষ্ঠায় ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন কুসুমের প্রতিষ্ঠান মেসার্স শাহ আমানত আয়রন মার্ট ও আল মদিনা এন্টারপ্রাইজের সম্পত্তি ইস্টার্ন ব্যাংকের পক্ষে নিলামে ওঠার আদেশ জারি করেন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত।

ঋণের টাকা শোধ না করায় চট্টগ্রামের আরেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের সম্পত্তিও নিলামে তুলেছে যমুনা ব্যাংক। এর আগে ব্যাংকটি ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল ও তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ঋণখেলাপির মামলা করে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে। জানা গেছে, ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের কাছে জনতা ব্যাংকের লালদীঘি শাখার পাওনা ১৬২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের লালদীঘি শাখার পাওনা ১৫৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যমুনা ব্যাংক চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী শাখা পাবে ১২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।

অনেকবার সময় দেওয়ার পরও টাকা পরিশোধ না করায় এরই মধ্যে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, নাসিরাবাদ ও ঢাকার বনানীতে থাকা ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে তুলেছে যমুনা ব্যাংক। আবার এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এফঅ্যান্ডএফ শিপ রিসাইক্লিংয়ের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে অগ্রণী ব্যাংক। আরেক অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এম কে স্টিল রি-রোলিংয়ের সম্পত্তি নিলামে তুলতে অর্থঋণ আদালতে মামলা ঠুকেছে এবি ব্যাংক। এফঅ্যান্ডএফ শিপের কাছে ব্যাংকটির বর্তমান পাওনা প্রায় ৩২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এ ছাড়া পূবালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১৯ কোটি ও ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে তাদের কাছে। এর বাইরে ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের কাছে প্রাইম ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার পাওনা প্রায় ৫৮ কোটি টাকা। পূবালী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার পাবে প্রায় ৪৪ কোটি টাকা। আগ্রাবাদ শাখা পাবে ২২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। যমুনা ব্যাংক ভাটিয়ারী শাখা পাবে প্রায় ১৩ কোটি টাকা। ব্র্যাক ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১২ কোটি ও ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার প্রায় সাত কোটি টাকা পাওনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কাছে। সব মিলিয়ে মোহাম্মদ জয়নাল আবেদিনের মালিকানাধীন মেসার্স ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে মামলা হয়েছে অর্থঋণ আদালতে। ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় এখন আত্মগোপনে আছেন তিনি।

ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন কুসুম ও জয়নাল আবেদিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়। জয়নাল আবেদিনের প্রতিষ্ঠান ম্যাক গ্রুপের ম্যানেজার মোহাম্মদ জাফর বলেন, ‘স্যার কোথায় আছেন, তার জানা নেই। সম্ভবত বিদেশে আছেন। ম্যাক গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠান আপাতত বন্ধ আছে।’ কিছু সম্পদ নিলামে উঠেছে স্বীকার করে ম্যানেজার জাফর বলেন, ‘কিছু ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিল করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু এটিতে বিশ্বাস না করে যমুনা ব্যাংক কিছু সম্পত্তি নিলামে তুলেছে।’

এর আগে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সম্পত্তি নিলামে তোলেন আদালত। দেড় হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পেরে নিলামে ওঠে নূরজাহান গ্রুপ, মোস্তফা গ্রুপ, এমইবি গ্রুপ, সিদ্দিক ট্রেডার্স, হারুন ট্রেডিং, এসএস ইন্টারন্যাশনাল, রুমানা এন্টারপ্রাইজ, মনোয়ারা ট্রেডিং, আইমান এন্টারপ্রাইজ, মইনুদ্দিন করপোরেশনসহ বিভিন্ন কোম্পানির সম্পত্তি। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা সর্বোচ্চ ৫৯৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকার সম্পত্তি নিলামে তোলে নূরজাহান গ্রুপের। নূরজাহান গ্রুপের পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দার কারণে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় অব্যাহতভাবে লোকসান দিতে হয়েছে তাদের। এ জন্য সময়মতো কিছু ব্যাংকের ঋণের টাকা দিতে পারেননি। তবে এখন ব্যবসা কিছুটা গুছিয়ে এনেছেন তারা। এরই মধ্যে তাদের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *