ঢাকা : ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৫ সালের আগে ও পরে দেশব্যাপী হামলা, নাশকতা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, পেট্রল বোমা নিক্ষেপসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিএনপি বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। এর মধ্যে বাদ যাননি দলটির চেয়ারপারসন, ভাইস চেয়ারপারসনসহ উচ্চ পর্যায়ের নেতারাও।
বিশেষ আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধির অপপ্রয়োগ করে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বিএনপিকে দুর্বল করতে এবং গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করতে দিন দিন মামলার সংখ্যা বাড়ছে বলে অভিযোগ দলের নেতা-কর্মীদের।
বিএনপির দপ্তরের হিসাব বলছে, গত বছরের ২ আগস্ট পর্যন্ত কেন্দ্রীয় নেতাসহ সারা দেশে তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ২১ হাজার ৬৮০টি মামলা হয়েছে। এতে আসামির সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৩ হাজার ৮৭৮ জন। এর মধ্যে খালেদা জিয়াসহ কেন্দ্রীয় ১৫৮ জন নেতার বিরুদ্ধে আছে ৪ হাজার ৩৩১ মামলা। আর দলের স্থায়ী কমিটির ১২ জন সদস্যের বিরুদ্ধে আছে ২৮৮টি মামলা।
এ ছাড়া সারা দেশে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জেলে আছেন ১৭ হাজার ৮৮৫ জন নেতা-কর্মী। তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই মামলার সংখ্যা ২৫ হাজার দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।
চলমান হাজার হাজার মামলার মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ২০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কে নতুন করে তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা যোগ হয়েছে। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাঁচটি মামলা। বাকিগুলো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় করা সহিংসতা, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির পিটিশন মামলা।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি
দুদকের করা পাঁচটি মামলার মধ্যে রয়েছে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলা ও নাইকো দুর্নীতি মামলা।
ওই মামলাগুলোর মধ্যে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাক্ষী গ্রহণ শেষ হয়েছে। এখন তদন্ত কর্মকর্তার (আইও) জেরা চলছে। চলতি মাসেই এর তারিখ রয়েছে। এরপরই বিচারক এ মামলায় রায় দেবেন।
মামলার অভিযোগে অনুসারে, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এ মামলাটি করে দুদক। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলাটি করে দুদক।
২০১০ সালের ৫ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান।
সম্প্রতি এই মামলায় সাক্ষীদের সকল সাক্ষ্য বাদ চেয়ে করা লিভ টু আপিল খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগ। এর আগে হাইকোর্টে এ মামলার সাক্ষিদের সাক্ষ্য বাতিল চেয়ে একটি রিট আবেদনও খারিজ হয়ে যায়।
বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ঠিকাদারি কাজে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় মামলাটি করে দুদক। মামলায় খালেদা জিয়াসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়। আইনজীবী অ্যাডভোকেট মেজবাহ জানান, হাইকোর্টে মামলাটির শুনানি শেষ হয়েছে। তবে এখনো কোনো আদেশ হয়নি।
গ্যাটকো দুর্নীতি
কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য গ্যাটকো লিমিটেডকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রাষ্ট্রের এক হাজার কোটি টাকা ক্ষতির অভিযোগে খালেদা জিয়া ও তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোসহ ১৩ জনকে আসামি করে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বরে তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুদক। হাইকোর্টে মামলাটির শুনানি শেষে মামলাটি নিম্ন আদালতে চলতে বাধা নেই বলে রায় প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি এই রায় নিম্ন আদালতে পৌঁছানোর ২ মাসের মধ্যে খালেদাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করতেও বলা হয়েছে।
নাইকো দুর্নীতি
নাইকো রিসোর্স কোম্পানিকে অবৈধভাবে কাজ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর মামলা করে দুদক। জজকোর্টে এ মামলার অভিযোগপত্র গঠনের শুনানি চলছে।
অন্যান্য মামলা
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সহিংস ও নাশকতার অভিযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর গুলশান ও কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম থানায় ২টি, খুলনা সদর থানায় একটি এবং রাজধানীর যাত্রাবাড়ি থানায় তিনটি মামলা উল্লেখযোগ্য। গুলশান, কুমিল্লা ও খুলনার মামলাগুলো তদন্তাধীন। তবে যাত্রাবাড়ি থানার মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অভিযোগে চারটি পিটিশন মামলা রয়েছে। এ মামলাগুলোও তদন্তাধীন।
এ ছাড়া খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৩১টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টিতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। তারেকের স্ত্রী জোবাইদা রহমানও স্বামীর সঙ্গে দুদকের একটি মামলার আসামি। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মৃত আরাফাত রহমান কোকোও সাতটি মামলার আসামি ছিলেন।
দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির ১২ নেতার বিরুদ্ধে ২৮৮টি, আট ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ১৩১টি, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাত উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ১২৪টি, সাত যুগ্ম মহাসচিবের বিরুদ্ধে ২৫৪টি এবং চার সিটি মেয়রের বিরুদ্ধে ৩৮টি মামলা রয়েছে।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার মামলার অন্যতম আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া জানান, ‘এর আগে বিএনপি বিরোধীদল থাকাকালেও এর অর্ধেক মামলার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু এবারই প্রথম এত মামলা। সরকার তার স্বার্থ প্রতিষ্ঠার জন্য মিথ্যা মামলায় বিএনপিকে কুঁজো করতে চেয়েছে। আইনজীবীরা সাধ্যমতো এসব মামলার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছি।’
তবে আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়ার বক্তব্য প্রাসঙ্গিক নয় বলছেন ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু।
‘৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি বিভিন্ন সময় যে তাণ্ডব চালিয়েছে তা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। বিএনপি ক্ষমতার লোভে মানুষ পর্যন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছে। তাই নাশকতার অভিযোগে বিএনপির বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো করা হয়েছে তা প্রতিহিংসাপরায়ণ বা তাদের দমন-পীড়নের জন্য নয়। প্রকৃত অভিযোগের ভিত্তিতেই মামলাগুলো করা হয়েছে’, বলেন আব্দুল্লাহ আবু।