ট্টগ্রাম : ‘আহা আজি এ বসন্তে/ এত ফুল ফোটে/এত বাঁশি বাজে/ এত পাখি গায় আহা আজি এ বসন্তে।’- কবি গুরুর এ গানটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় নিসর্গে ঋতুরাজ বসন্তের রঙিন শাসন শুরু হয়ে গেছে। বাতাসে ফুলের গন্ধ, মৌমাছিদের উতরোল আর কোকিলের ডাক জানিয়ে দিচ্ছে বসন্তের আগমনী বার্তা।
বসন্ত মানে কুয়াশার ঘোমটা খুলে প্রকৃতিতে হাজারো ফুলের সমারোহ। ফুল মানেই রঙের মেলা। ফুল ফুটবার পুলকিত এই দিনে বন-বনান্তে কাননে কাননে পারিজাতের রঙের কোলাহলে ভরে উঠে চারদিক। যেদিকেই চোখ যায়, শুধু নয়নাভিরাম ফুল আর ফুল। বসন্তের ফুল নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন –
পলাশ : আমাদের জাতীয় কবি নজরুল লিখেছেন- ‘হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল/ এনে দে এনে দে নইলে/ বাঁধব না, বাঁধব না চুল..’। বাংলা সাহিত্যে পলাশ ফুল যথেষ্ট জায়গা দখল করে আছে। পলাশ ফুলের আগুন ঝরা শিখা বসন্তের উজ্জ্বল রোদে দ্যুতি ছড়ায়। সনাতন ধর্মালম্বীরা মনে করেন, পলাশ ফুলগাছ হলো অগ্নিদেবের গঠন, অর্থাৎ আগুনের দেবতা। তাই পলাশকে বলা হয় বনের আগুন। পলাশ ফুলের রঙ দিয়ে দোলযাত্রায় হোলি খেলা হয়।
পলাশের বৈজ্ঞানিক নাম Butea monasperma, এটি Papilionaceae পরিবারের অন্তর্গত। পলাশ মাঝারি আকারের ১০ থেকে ১২ মিটার উচ্চতার পত্রঝরা উদ্ভিদ। ফুলটি নানা রঙের গন্ধহীন ফুল। পলাশ ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় জন্মে। শীতে গাছের পাতা ঝরে যায়। বসন্তে এ গাছে ফুল ফোটে। টকটকে লাল ছাড়াও হলুদ ও লালচে কমলা রঙের পলাশ ফুলও দেখা যায়। পলাশ ফুল দেখতে অনেকটা বাঘের নখের মতো। কিন্তু এটি ঔষধি ফুলও; নানা রোগের চিকিৎসায় পলাশ ফুল ব্যবহৃত হয়।
শিমুল : কবি লিখেছেন- ‘শিমুল কলি যেন,স্বর্ণালি বর্ণালি আর রূপালী/ সবুজ ঘেরা ঐ গাঁয়,খুব চিনা জানা তার ছোট/ কুড়িটির উঠান পাশ,লম্বা মোটা শিমুল গাছ।’ শীতের শেষ থেকেই প্রকৃতিতে এর আগমন ঘটে শিমুল ফুলের। শিমুল ছাড়া বসন্তকে কল্পনাই করা যায় না। গাছের পাতা ঝরা শেষ হলেই শুকনো গাছের ডালে ডালে ফাল্গুনে রক্ত রাঙা শিমুল ফুল ফোটে। টকটকে লাল রঙের এ ফুলটি শুধু মানুষকেই নয়, আকৃষ্ট করে পাখিদেরও।
শিমুলের বৈজ্ঞানিক নাম Bombax ceiba। ইংরেজি নাম Silk cotton. পাতাঝরা বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। এ গাছের উচ্চতা ২৫ থেকে ৩০ মিটার। ফুল অনেক বড়। পাতা ১০ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার চওড়া হয়। পাতার অগ্রভাগ সরু। শিমুলের আদিবাস আমেরিকা ও ভারত।ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ চীন, মালয়, হংকং ও তাইওয়ানে ব্যাপকভাবে এ গাছের চাষ হয়। চৈত্র মাসে ফল ফেটে শিমুল তুলা বেরিয়ে আসে।
কৃষ্ণচূড়া : আধুনিক বাংলা গানের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী গীতা দত্ত গেয়েছিলেন, ‘কৃষ্ণচূড়া আগুন তুমি আগুন ঝরা বানে/খুন করেছ শূন্য তোমার গুন করেছ গানে/…তুমি আমার আলোর নেশা বিভোর ভোরময়/কৃষ্ণচূড়া তুমি আমার প্রেমের পরিচয়।’ ফুলের জগতে কৃষ্ণচূড়ার মতো এমন উজ্জ্বল রঙের ফুল বেশ দুর্লভই বটে। বর্ষার শেষেও এই গাঢ় লাল- কমলা ফুলের রেশ শেষ হয় না। তবে শীতের হিমেল হাওয়ায় গাছটির পাতাগুলো ঝরে যায়। বসন্তে- গ্রীষ্মে গাছগুলো আবার ভরে ওঠে গাঢ় লালে- কমলায়।
কৃষ্ণচূড়ার বৈজ্ঞানিক নাম Delonix regia। ইংরেজি নাম Flame tree। এটি Leguminosae পরিবারের অন্তর্গত। গাছটি ১৫ থেকে ২০ মিটার লম্বা হয়। কৃষ্ণচূড়া গাছে লাল, কমলা, হলুদ এবং মেরুন রঙের ফুল ফোটে। ফুলগুলো বড় চারটি পাপাড়ি যুক্ত। পাপড়িগুলো ৮ থেকে ১২ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। বসন্তের মাঝামাঝি বিচিত্র সাজে গুচ্ছ গুচ্ছ ফলে গাছ ভরে যায়। কোথাও বা একটু দেরিতে ফুল ফোটে। আফ্রিকা, হংকং দক্ষিণ চীন, তাইওয়ান, বাংলাদেশ ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে কৃষ্ণচূড়া জন্মে থাকে। শুষ্ক অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে কৃষ্ণচূড়ার পাতা ঝরে গেলেও, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এটি চিরসবুজ।
চাঁপা : কবি লিথেছেন, ‘অশান্তির বিষবৃক্ষ, কণ্টকময় বিষফল চৌদিক/ বন্ধ কর ছোটাছুটি, হতাশায় দিগ্বিদিক/ সুবাসিত করো জীবন, চাঁপাফুল ঘ্রাণে/ মানবীয় মানবতা তরে মিলেমিশে প্রাণে।’ আমাদের দেশে চাঁপা নামে যতগুলো ফুল আছে, তার খ্যাতি মূলত সুগন্ধের জন্য। আর ওদের বর্ণবৈচিত্র্য হচ্ছে আমাদের বাড়তি পাওনা। শুধু এখানেই নয়, চাঁপার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। নেই নেই করেও আমাদের দেশে চাঁপা ফুলের সংখ্যা একেবারে কম নয়। তবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে চাঁপা নামের সব ফুলই কিন্তু চাঁপা নয়। প্রচলিত নাম চাঁপা হলেও মূল চাঁপা ফুলের সঙ্গে বৈশিষ্টগত অনেক পার্থক্য রয়েছে। স্বর্ণচাঁপা, কাঠচম্পা, হিমচাঁপা কনকচাঁপা বা কুসুম ফুল নাম যাই হোক, চাঁপা অসাধারণ আর অদ্ভুত ধরনের ফুল।
প্রকৃত চাঁপার ইংরেজি নাম ম্যাগনোলিয়া। চাঁপা ফুলের গাছ চিরসবুজ। মানে গাছে সারা বছরই পাতা থাকে। পাতাগুলো লম্বাটে। আর ফুলের রঙ সাধারণত সাদা, কিংবা হালকা হলুদ, সোনালিও বলতে পারো। আর এই ফুলের যা সুন্দর গন্ধ! বসন্ত থেকে বর্ষাকাল পর্যন্ত চাঁপা ফুল ফোটার সময়। বসন্তকালেই সবচেয়ে বেশি ফোটে। তবে এক শীতকাল ছাড়া প্রায় সব সময়েই চাঁপা ফুল ফুটতে দেখা যায়।
নাগেশ্বর : পূর্ব-শ্রীহট্টের লোকগীতিতে নাগেশ্বরকে নিয়ে কয়েকটি পঙ্ক্তি আছে- ‘নাচেন ভালা সুন্দরী লো/ বাঁধেন ভালা চুল/ যেন হেলিয়া দুলিয়া পড়ে/ নাগকেশরের ফুল।’ নাগেশ্বর বা নাগকেশর ফুলের রঙ সাদা। আর গোলাকার মুকুলের রঙ সবজে-সাদা। ফুলের পাঁপড়ির রঙ আবার দুধ-সাদা। ফুলটা যে শুধু দেখতেই সুন্দর, তাই না, বেশ সুগন্ধিও বটে। নাগেশ্বর এই অঞ্চলের অনেক পুরনো ফুল। হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল থেকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারতের অনেক স্থানেই নাগেশ্বর সহজলভ্য। তবে আমাদের দেশে সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় তুলনামূলকভাবে একটু বেশি দেখা যায়।
নাগেশ্বরের বৈজ্ঞানিক নাম mesua nagassarium। নাগেশ্বর ফোটার প্রধান মৌসুম হচ্ছে বসন্ত। তবে বছরের অন্যান্য সময়েও ফুল থাকে। পাপড়ির রং দুধ-সাদা। মাঝখানে আছে এক থোকা সোনালি রঙের পরাগ কেশর। সব মিলিয়ে এই ফুল বর্ণে-গন্ধে অনন্য। গৃহসজ্জা ও পূজার উপকরণেও এ ফুল কাজে লাগে। ফলের রং প্রথমে তামাটে, পরে ধীরে ধীরে বাদামি রং ধারণ করে।এই ফুল শুধু সুন্দরী আর সুগন্ধি-ই নয়, একইসঙ্গে বেশ কাজেরও বটে। এই ফুল থেকে যেমন সুগন্ধি আতর তৈরি হয়, তেমনি নানা রোগের চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হয়। বীজ তেল জ্বালানি ও বাতের মালিশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফুল থেকে তৈরি আতরও উৎকৃষ্ট মানের।
সোনালু : সোনালু ফুলকে বলা হয় সোনালি ঝরণা ফুল। এটি থাইল্যান্ডের জাতীয় ফুল এবং এ ফুল গাছটিও থাইল্যান্ডের জাতীয় গাছ। হলুদ রঙের সোনালু ফুল দেখতে ভারি সুন্দর। ফুলগুলো হলুদ বর্ণের এবং পাপড়িগুলো অসমান। গাঢ় সবুজ রঙের পাতাগুলো যৌগিক, মসৃণ ও ডিম্বাকৃতির। বসন্তের মাঝামাঝি সোনালু ফুল ফুটতে থাকে বর্ষা পর্যন্ত।
সোনালু ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Cassia fistula। এটি Caesalpinieae পরিবারের অন্তর্গত। এই গাছের আদিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। গাছটি ৮ থেকে ১০ মিটার লম্বা, মাঝারি আকৃতির শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত সবুজ-ধূসর বর্ণের বৃক্ষ সোনালু ফুল ডালপালা থেকে ঝাড়ু লণ্ঠনের মতো ঝুলে থাকে। এ গাছের ফলগুলো দেখতে লাঠির মতো লম্বা বলে বানর লাঠি বা কৃষ্ণের বাঁশি নামেও পরিচিত। এ ফল থেকে নানা রোগের ওষুধ তৈরি হয়।
কাঠচাঁপা : সুদূর মেক্সিকো থেকে আসা এই ফুলটি আমাদের দেশে দারুণ জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তার কারণে তার নামও অনেক গুলাচি, গোলাইচ, গোলকচাঁপা, চালতা গোলাপ, গরুড়চাঁপা ইত্যাদি। কাঠগোলাপ দারুণ সুগন্ধিও। শীতের শেষ দিকে এই গাছের সব পাতা ঝরে পড়ে। বসন্তের শেষভাগে পাতাহীন ডালপালার মাথায় দু’এক থোকা করে ফুল ফুটতে শুরু করে। ফুল ও পাতার পরিপূর্ণতা আসে গ্রীষ্মকালে। তখন দূর থেকে মনে হয় গাছটি যেন প্রকৃতির বিশাল এক পুষ্পস্তবক। তারপর শীত অবধি পর্যায়ক্রমে ফুল ফুটতে থাকে। বর্ণে গন্ধে প্রাচুর্যে এবং অক্লান্ত প্রস্ফুটনে এমন পুষ্পতরু সত্যিই বিরল।
কাঠচাঁপার বৈজ্ঞানিক নাম Plumeria rubra। ইংরেজি নাম Pagoda tree। এই গাছটি ৮-১০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। বিচিত্র গড়ন ও বর্ণবৈচিত্র্য এই ফুলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোনো কোনো ফুল একেবারে দুধের মতো সাদা, কোনোটিতে সাদা পাপড়ির কেন্দ্রে স্পষ্ট হলুদ দাগ, আবার কোনোটি লালচে গোলাপি রঙের। আবার সাদা রঙের কিছু ফুল দীর্ঘ মঞ্জরিদণ্ডের আগায় ঝুলে থাকে।সুগন্ধি এই ফুল শুধু বাগানের সৌন্দর্য বর্ধণের জন্য নয়, অ্যারোমাথেরাপীতে ও ব্যবহৃত হয়।
বনজুঁই : বনজুঁইকে বলা হূয় বসন্তের সৌন্দর্য। অযত্নে অবহেলায় বেড়ে ওঠা ফুল বনজুঁই ক্ষুদ্রাকৃতির ঝোপালো গাছ। বন-জঙ্গল, রাস্তার ধার, পুকুর পাড়, বাঁধের ধার ও পতিত জমিতে বনজুঁই জন্মাতে দেখা যায়। গাছের পাতা সবুজ, মধ্য শিরা স্পষ্ট, ত্রিকোণাকৃতির। গাছের অগ্রভাগে ও শাখা-প্রশাখায় অসংখ্য ফুল ফোটে। ফুল ফোটার মৌসুম বসন্তকাল। ফুলের রং সাদা বেগুনি মিশ্র রঙের, ফুলের মাঝখানে লম্বা পুংকেশর। এ ফুলের সৌন্দর্য ও সুবাস মনোমুগ্ধকর। বনজুঁই ফুলগাছ অত্যন্ত কষ্ট সহিষ্ণু, পরিবেশ প্রতিকূলতায় বছরের পর বছর ধরে বেঁচে থাকে। ভেষজ গুণে গুণান্বিত এই গাছ ম্যালেরিয়া, চর্মরোগ ও পোকা-মাকড়ের কামড়ে উপকারী।