ক’দিন ধরেই বাতাসে ভাসছিল তার আগমনী বার্তা। বৃক্ষের ধূসর বর্ণহীন পাতা ঝরে পড়ছে। গাছের শাখা ঢেকে যাচ্ছে কচি নতুন পাতায়। কোথায় যেন ডাকছে কোকিল। আর ফুলের বাগানে শুরু হয়েছে রঙের হলি খেলা। প্রকৃতিতে ফুটে উঠেছে বর্ণিল, সুভাষিত এক ঋতু। কী নেই তার! রূপ, রস, লাবণ্য ছড়িয়ে পড়ছে মাতাল এক সমীরণে। প্রকৃতির নিয়মে শেষ পর্যন্ত ‘দখিন সমীরণের শিহরণ’ জাগাতে সেই মাহেন্দ্র দিন অবশেষে এসেই গেল। শীতের রুক্ষ, হিমেল দিনের অবসান ঘটিয়ে জেগে উঠল বসন্ত। আজ শনিবার সেই পহেলা ফাল্গুন। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনী দিন। অভিন্ন এক অনুভূতিতে আজ ভাসছে ভাটিবাংলা থেকে সারা বাংলা, ‘বসন্ত বাতাসে… সই গো/বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের
গন্ধ আমার বাড়ি আসে।’ যে প্রাণখোলা বুনো আনন্দে একদিন দুলেছিলেন শাহ আবদুল করিম, সে আনন্দ আজ সবার। উদ্বেল, ব্যগ্র হৃদয়ের মন্দিরে আজ দুলে দুলে উঠছে এই কামনা, ‘মধুর বসন্ত এসেছে, আমাদের মধুর মিলন ঘটাতে…’।
আজ শনিবার প্রভাতের নবীন উষা বাংলার প্রকৃতিতে নিয়ে এসেছে ঋতুরাজের দোলা। খুলে গেছে দখিনা দুয়ার। মানব-মানবীর হৃদয়ের বেদি আর প্রজাপতির রঙিন পাখা, মৌমাছির গুনগুনানি, বৃক্ষ-লতা-গুল্ম, ফুলে-ফলে, পত্র-পল্লবে, শাখায় শাখায়, ঘাসে ঘাসে, নদীর কিনারে, কুঞ্জ-বীথিকা আর অরণ্য-পর্বতে নবযৌবনের বান ডেকেছে। প্রকৃতির এই রূপতরঙ্গে দুলে উঠে কবিগুরু গেয়ে ওঠেন_ ‘ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে।’ গেয়ে ওঠেন_ ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/আমার আপনহারা প্রাণ/আমার বাঁধনছেঁড়া প্রাণ’। আজও সেই সুর ধ্বনিত হচ্ছে প্রতি হৃদয়ে। শীতের স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়া, বিবর্ণ জারুল-পারুল, মাধবী-মালতী-রজনীগন্ধা, পলাশ-জবা, কৃষ্ণচূড়া-দোপাটি, কনকচাঁপার গুচ্ছ আন্দোলিত হচ্ছে দখিনা বাতাসে নবজীবনের স্পন্দনে। আড়মোড়া ভেঙে বাতাসে হিল্লোল তুলছে আম-কাঁঠালের বাগান। এ সময়ের কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায়ও রয়েছে এই ঋতুর বন্দনা :’হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যত আছে,/হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে/ …তবুও ফুটেছে জবা, দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে,/তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্তপথিক’।
শুধু প্রাণের দুরন্ত আবেগ আর প্রেমে নয়, এ ঋতুতে বাংলার মানুষ জেগে ওঠে দ্রোহে-প্রতিবাদে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো বার্তা ছড়ায়, ‘এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/খুনেরা ফাগুন..।’ মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার চেয়ে বাংলার তরুণরা রক্ত ঝরিয়েছে এ ঋতুতে। আবার সামরিক-স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়েও রক্ত ঝরিয়েছে এই বসন্তে। তাই দোসরা ফাল্গুন ‘সামরিক-স্বৈরাচারবিরোধী গণতন্ত্র দিবস’। বিদ্রোহ আর উৎসব এ ঋতুতে চলে হাত ধরাধরি করে। মোগল সম্রাট আকবর দূর অতীতে ১৫৮৫ সালে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন। যার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল ‘বসন্ত উৎসব’। এ উৎসব মহানগর ঢাকা থেকে সারাদেশে নতুন করে তরঙ্গিত হতে শুরু করেছে ১৪০১ বঙ্গাব্দ থেকে। পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত উৎসবের রঙে মেতে ওঠে তরুণ হৃদয়, নতুন করে প্রাণ পান প্রবীণেরা। বসন্তে শুধু প্রকৃতিই নয়, হৃদয়ও রাঙা হয়ে ওঠে। বসন্ত তাই অনেকের কাছে ‘প্রেমের ঋতু’। শচীন কর্তার মতো তাই সকলের মনে অনুরণিত হয়_ ‘শোন গো দখিনা হাওয়া/ প্রেম করেছি আমি’।
ফুলের মঞ্জরিতে মালা গাঁথার দিন বসন্ত কেবল প্রকৃতিকেই রঙিন করেনি, রঙিন করেছে আবহমান কাল ধরে বাঙালি তরুণ-তরুণীর প্রাণ। তাই আজ পহেলা ফাল্গুনের এ দোলা জাগানো দিনে তরুণীরা খোঁপায় গাঁদা-পলাশ ফুলের মালা গুঁজে বাসন্তি রঙ শাড়ি পরে, তরুণেরা পাঞ্জাবি-পায়জামা কিংবা ফতুয়ায় খুঁজে নেয় শাশ্বত বাঙালিয়ানা। আজ তাই উৎসবের হাওয়ায় তরুণ-তরুণীদের ভাসতে দেখা যাচ্ছে শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, টিএসসি আর অমর একুশে বইমেলাসহ নগরের নানা স্থানে। এমনকি দূর মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছে তারুণ্যের এই যাত্রা। ফোনে, ফেসবুক, গুগল প্লাস ও টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে চলছে বসন্তের শুভেচ্ছা বিনিময়।
বসন্ত উদ্যাপন :বসন্তকে স্বাগত জানাতে ‘এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’ স্লোগানে আজ শনিবার রাজধানীর চারটি মঞ্চে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছে জাতীয় বসন্ত উদ্্যাপন পরিষদ। যার মূল আয়োজনটি হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায়। এ ছাড়া লক্ষ্মীবাজারের বাহাদুর শাহ পার্ক, ধানমণ্ডি লেকের রবীন্দ্রসরোবর ও উত্তরার ৭ নম্বর পার্কের মাঠে বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠান হবে।
এ ছাড়া কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে সঙ্গীত সংগঠন ‘রবিরাগ’ আয়োজন করেছে ‘ভালোবাসার বসন্ত’ অনুষ্ঠান। সন্ধ্যা ৭টায় সুফিয়া কামাল কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে এ উৎসব হবে। এতে অংশ নেবেন সংগঠনের সভাপতি আমিনা আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক সাদী মহম্মদ, তাপস দত্ত ও ইকবাল বাহার চৌধুরী। নৃত্য পরিবেশন করবেন নৃত্যাঞ্চলের নৃত্যশিল্পীরা।