রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চোখের চিকিৎসা নিতে গিয়ে পাঁচ রোগী চোখ হারিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে জামালপুরের হনুফা বেগম, নারায়ণগঞ্জের আলো বেগম, মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা সেলিনা বেগম, মিরপুরের আলেয়া বেগমসহ পাঁচ রোগীর চোখের ছানি অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পর তারা আর চোখে দেখতে পাননি। রোগী ও স্বজনরা এ ঘটনার জন্য চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসাকে দায়ী করেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিল। কমিটির প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখেনি।
শুধু চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট নয়, দেশের সরকারি ও বেসরকারি সব পর্যায়ের হাসপাতালেই এভাবে ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন রোগীরা। অনেকে চিরতরে প্রতিবন্ধী হচ্ছেন, আবার অনেকে মৃত্যুবরণও করছেন। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু ও প্রতিবন্ধী হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে চিকিৎসককে মারধর, মামলা দায়ের, হাসপাতালে ভাংচুর এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসকদের কর্মবিরতির ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তুলকালাম ঘটেছে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনেও ভুল চিকিৎসায় রোগীর প্রতিবন্ধিত্বের চিত্র ফুটে উঠেছে। চির প্রতিবন্ধিত্বের শীর্ষ পাঁচটি কারণের মধ্যে ভুল চিকিৎসা একটি প্রধান কারণ। বিবিএস জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট প্রতিবন্ধীর মধ্যে ৩ শতাংশ ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে প্রতিবন্ধিত্ববরণ করেছেন। প্রতিবেদনে সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো_ গত দুই বছরের ব্যবধানে দেশে ভুল চিকিৎসার হার বেড়েছে।
সরকারের নীতিনির্ধারণে সহায়তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ আর্থসামাজিক সূচকের তথ্য বিবিএস সংগ্রহ করে থাকে। এ জরিপের জন্য ১৯৮০ সাল থেকে ১০টি খাতের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সর্বশেষ জরিপে নমুনার সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়ানো হয়েছে।
বছরব্যাপী প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে বিবিএস।
সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের এক হাজার মানুষের মধ্যে নয়জন প্রতিবন্ধী। এর ৩ শতাংশ ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে চিরতরে প্রতিবন্ধী হয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নারীরা। শহরের সাড়ে ৩ শতাংশ ও গ্রামের ৩ শতাংশ নারী ভুল চিকিৎসায় স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ২০১২ সালে বিবিএস ভুল চিকিৎসা বিষয়ে প্রথম তথ্য সংগ্রহ করে। ওই বছর ভুল চিকিৎসার কারণে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্তের হার ছিল আড়াই শতাংশ।
বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জন্মগত কারণে ৫০ শতাংশ, দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ, অসুস্থতার কারণে ২১ দশমিক ৪০ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী হচ্ছে। এর বাইরে বার্ধক্যজনিত কারণে ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী হয়েছে। এসব প্রতিবন্ধী হওয়া মানুষের মধ্যে ৭ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত। বিভাগ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী হওয়া মানুষের হিসাবও করেছে বিবিএস। সংস্থাটির হিসাবে এক হাজার মানুষের মধ্যে বরিশালে ৯, চট্টগ্রামে ৯, ঢাকায় ৮, খুলনায় ১০, রাজশাহীতে ১০, রংপুরে ১২ ও সিলেটে ৮ জন ভুল চিকিৎসার বলি হয়ে চিরতরে প্রতিবন্ধী হয়ে গেছেন।
বিবিএসের মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশের (এমএসভিএসবি) প্রকল্প পরিচালক এ কে এম আশরাফুল হক বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় মানুষ কেন পঙ্গুত্ব এবং প্রতিবন্ধী হচ্ছে, তার কারণ খুঁজে বের করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, মানুষের শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ার অন্যতম কারণ ভুল চিকিৎসা। এ কারণে কেউ কেউ চিরদিনের মতো অন্ধ, বধির, বিছানা থেকে উঠতে না পারা, খাওয়াসহ ব্যক্তিগত কাজে অক্ষম হয়ে পড়েছেন।
ভুক্তভোগী কয়েকজন রোগী ও স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে অভিযোগ করেও তারা কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। অভিযোগ করার পর তদন্ত কমিটি করা হয়। কোনো কোনো সময় তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় না। আবার তদন্ত প্রতিবেদন দিলেও তাতে চিকিৎসকদের নির্দোষ বলে দেখানো হয়।
ভুক্তভোগীদের ধারণা, চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়, তারাও চিকিৎসক। এ কারণে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তকে নির্দোষ বলে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এতে করে ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন।
তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গাউছিয়া ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার সহকারী মৌলভি আবদুর রহিম খান ২০১২ সালের নভেম্বরে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চোখের ছানি অপারেশন করতে যান। অপারেশনের পর তার এক চোখ অন্ধ হয়ে যায়। ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে আবদুর রহিম খান চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে উচ্চ আদালতের নির্র্দেশে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দেয়। পাঁচ সদস্যের কমিটি ছয় মাস তদন্ত করে চিকিৎসককে নির্দোষ বলে ঘোষণা দেয়।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, চিকিৎসকদের সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) যথাযথভাবে অভিযোগ দায়ের করলে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা আদালতেও মামলা করতে পারেন।
বিএমডিসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বিএমডিসি মাত্র তিনজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। এর বাইরে আর কেউ বিএমডিসিতে অভিযোগ করে প্রতিকার পাননি। তবে প্রতিষ্ঠানটিতে শত শত অভিযোগ জমা পড়েছে।
অভিযোগ দেওয়ার পরও কেন অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না_ এমন প্রশ্নের জবাবে বিএমডিসির রেজিস্ট্রার ডা. জাহেদুল হক বসুনিয়া বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়ায় দায়ের না হওয়ায় বেশিরভাগ অভিযোগ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম-ঠিকানাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি। অভিযোগে অসম্পূর্ণতা থাকলে তা তদন্ত করে দেখার সুযোগ থাকে না। তাই অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিবিএসের জরিপ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশের একজন চিকিৎসককে দিনে ১২০ জনের বেশি রোগীকে সেবা দিতে হয়। বিশ্বের কোথাও এত রোগী দেখার ইতিহাস নেই। এ কারণে চিকিৎসায় ভুলের অভিযোগ উঠতে পারে। তবে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে বেশি মামলা হলে তারা ঝুঁকি নিতে চাইবেন না বলে মনে করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, বিবিএসের ওই জরিপ নিয়ে প্রশ্ন আছে। কোন প্রক্রিয়ায় জরিপকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। তারা সরাসরি ভুল চিকিৎসায় রোগী প্রতিবন্ধী হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। কিসের ভিত্তিতে তারা এটি দাবি করেছে, তা খতিয়ে দেখা উচিত।
ডা. রশিদ-ই মাহবুব আরও বলেন, বাংলাদেশে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে যত মামলা হয়েছে, তার বেশিরভাগই ফৌজদারি আইনে করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভুল চিকিৎসার অভিযোগে সিভিল কোর্টে মামলা হয়। এতে রোগীরাও ক্ষতিপূরণ পান। তাই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা ফৌজদারি, না সিভিল কোর্টে মামলা করবেন_ তা নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।
বিশিষ্ট আইনজীবী শাহ্দীন মালিক বলেন, ভুল চিকিৎসার কারণে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ থাকলেও আইনজীবীদের অজ্ঞতা এবং ভুক্তভোগী রোগীর আত্মীয়স্বজনের প্রতিহিংসার কারণে সম্ভব হচ্ছে না। ভুল চিকিৎসার কারণে দুনিয়াব্যাপী ক্ষতিপূরণের মামলা হয়। দেশে ভুলের কারণে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হলে চিকিৎসকরা রোগীর প্রতি অবহেলা করার সাহস পাবেন না। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি মনজিল মোরসেদ বলেন, চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসার কারণে ভুক্তভোগীর মামলা করার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ এবং ফৌজদারি দুই ধরনের মামলা করার সুযোগ রয়েছে। তবে অনেকে বিষয়টি জানেন না। এ কারণে ভুল চিকিৎসা দিয়েও অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন।