যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও তার সন্তানরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারাতে যাচ্ছেন। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন, ২০১৬-এর খসড়া তৈরি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আনুগত্য প্রকাশ করলে, বিদেশি রাষ্ট্রের কোনো বাহিনীতে যোগদান করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে বা অন্য কোনোভাবে ওই বাহিনীকে সহায়তা করলে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক থাকতে বা হতে পারবেন না।
খসড়ায় বলা হয়েছে, আইনে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নাগরিক হলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে নাগরিক হলে তার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকার অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইনে কোনো এমপি, মন্ত্রী, বিচারকসহ সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের দ্বৈত নাগরিক হওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ ছাড়া প্রজাতন্ত্রে বিভিন্ন কর্মে বা পদে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও দ্বৈত নাগরিক হতে পারবেন না।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক বলেন, বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই নতুন আইন করা হচ্ছে। আইনে কিছু নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে। আরও কিছু বিষয় পরিষ্কার করা হয়েছে। তিনি বলেন, নতুন বিষয়ের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষ অবদানে বিদেশি নাগরিকদের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। আগে বিশেষ নাগরিকত্ব দেওয়া হতো শুধু গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য। এখন কয়েকটি ক্যাটাগরিতে অবদানের জন্য সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বিদেশি নাগরিকদের। এ ছাড়া তাদের রাজনীতি করার বিষয়টিও স্পষ্ট করা হয়েছে আইনে।
যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও তার সন্তানদের নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়ে তিনি বলেন, আইনে নাগরিক না থাকার বা না হওয়ার কিছু বিধান রয়েছে। যদি কেউ এর মধ্যে পড়েন, তাহলে তার নাগরিকত্ব বাতিল হবে। তবে তারা এর মধ্যে পড়ছেন কি-না, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, আইনটি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন বা কোনো বিদেশি বাহিনীকে বাংলাদেশবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্রের সহায়তা করেছেন, তাদের নাগরিকত্ব বাতিল হবে। এমনকি তাদের সন্তানরাও নাগরিক হতে পারবেন না। এটি আইন পাস হলে বিধি দ্বারাই স্পষ্ট করা হবে।
বাংলাদেশে নাগরিকত্ব প্রদান, নাগরিকত্ব বাতিলসহ প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘দ্য বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ (টেম্পোরারি প্রভিশনস) অর্ডার, ১৯৭২’ বলবৎ রয়েছে। এ-সংক্রান্ত মূল আইন হচ্ছে ‘দ্য সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট, ১৯৫১’। বহিরাগমন, নাগরিকত্ব অর্জন, সংরক্ষণ, পরিত্যাগ, অবসান ইত্যাদি বিষয়ের সমাধান দেওয়া এ দুটি আইনে সম্ভব হচ্ছে না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুটি আইন একীভূত করে নতুন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে।
খসড়া আইনের ১৮ ধারায় নাগরিক হতে বা থাকতে পারবেন না এমন ব্যক্তিদের বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশে নাগরিক হওয়ার বা থাকার যোগ্য হবেন না যদি তিনি দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্র ব্যতীত কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আনুগত্য প্রকাশ করেন, বিদেশি রাষ্ট্রের কোনো বাহিনীতে যোগদান করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন বা অন্য কোনোভাবে ওই বাহিনীকে সহায়তা করে থাকেন, এমন কোনো দেশের নাগরিক বা অধিবাসী যে রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল বা আছে, বাংলাদেশে বেআইনি অভিবাসী হিসেবে বসবাস করে থাকেন। এ ধারা অনুযায়ীই যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত কোনো ব্যক্তি নাগরিক থাকতে পারবেন না বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়।
আইনের ৫ ধারায় বাংলাদেশের বাইরে জন্মগ্রহণকারী বা বাংলাদেশি বংশসূত্রে নাগরিক হওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাইরে জন্মগ্রহণ করলেও বাংলাদেশের নাগরিক হবেন যদি তার বাবা বা মা এই আইন কার্যকর হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন; কোনো ব্যক্তি বংশসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হবেন না যদি তার জন্মের দুই বছরের বা এই আইন বলবৎ হওয়ার দুই বছরের মধ্যে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি মিশনে তার জন্মনিবন্ধন না করান। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি তার বাবা-মা বিদেশি কোনো বাহিনীতে যোগদান করে বা যোগদান ছাড়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন বা যুদ্ধে সহযোগিতা করেন বা বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, তাহলে তারা নাগরিক থাকতে বা হতে পারবেন না। এ ধারা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সন্তানদের নাগরিকত্ব বাতিল হবে বলে সূত্রে জানা গেছে।
আইন অনুযায়ী কোনো অভিবাসীকে নাগরিক করা যাবে না। কেউ যদি তাদের নাগরিক করার বিষয়ে সহায়তাও করেন, তাদের শাস্তি পেতে হবে। আইনে কোনো বিদেশি নাগরিককে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো বিদেশি নাগরিককে তার সামাজিক, বিজ্ঞান, সাহিত্য, বিশ্বশান্তি, মানব উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশেষ যোগ্যতা বা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করা যাবে। তবে তারা বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক সংগঠনে জড়িত, এমপি, স্থানীয় সরকারসহ কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এর বাইরেও কোনো বিদেশি নাগরিককে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দেওয়া হলে তারাও কোনো রাজনৈতিক সংগঠনে জড়িত, এমপি-স্থানীয় সরকারসহ কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
আইনের খসড়ায় কোনো বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশি কোনো ব্যক্তিকে বিয়ে করলে তাকে শর্তসাপেক্ষ নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। শর্তের বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশি কোনো নাগরিক বিদেশি নাগরিককে বিয়ে করলে, যদি ওই বিয়ে সম্পর্কে বৈধতার কোনো প্রশ্ন না থাকে, সরকার ওই বিদেশি নাগরিককে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করতে পারবে- যদি তিনি বাংলাদেশে কমপক্ষে পাঁচ বছর বসবাস করে থাকেন এবং সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো দেশের নাগরিক না হন এবং তার বাবা-মাসহ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না থাকেন। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এমন কোনো দেশের নাগরিক হলে বা বিদেশি শত্রু বাহিনীর সদস্য হয়ে থাকলে তাকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।
আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক সরকার কর্তৃক গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা নাগরিকত্ব গ্রহণের নিষিদ্ধ ঘোষিত রাষ্ট্র ব্যতীত বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এমন রাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবেন।
প্রসঙ্গত, একাত্তরে দেশে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারকাজ চলছে। এরই মধ্যে এ অপরাধে ২২টি মামলার রায় হয়েছে। এতে দণ্ডিত হয়েছেন ২৪ জন। আরও ১০টি আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। বিচারকাজ চালানোর জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে চারটি মামলার বিচার চলছে। এ ছাড়া ২৩টি মামলায় ৬৮ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। অন্যদিকে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা করারও উদ্যোগ নিয়েছে।