রাজধানীর পুরান ঢাকায় হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি জমায়েতে বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। তদন্তে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) তিনজন ‘ফিদাইল’সহ অন্তত ১০ জন আসামির তালিকায় রয়েছে। ফিদাইলরা জেএমবিতে আত্মোৎসর্গকারী হিসেবে পরিচিত। সংগঠনের প্রয়োজনে যে কোনো সময় তারা নিজেদের ‘বিসর্জন’ দিতে প্রস্তুত থাকেন।
হোসেনী দালানে বোমা হামলার ঘটনায় পাঁচটি গ্রুপে ১২ জন জড়িত ছিলেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে পাঁচটি হাত বোমা নিক্ষেপ করেন জেএমবির সামরিক কমান্ডার আলবানি ওরফে হোজ্জা ওরফে শাহাদাত এবং জাহিদ হাসান রানা ওরফে মুসয়াব।
আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থি সংগঠনের দৃষ্টি আকর্ষণ ও অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিয়া মতাবলম্বীদের ওপর হামলা করা হয়। ঘটনার দুই মাস আগে এ হামলার পরিকল্পনা হয়। দেশের চারটি এলাকায় দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ। হামলায় জড়িতরা জেএমবির নেতাকর্মী হলেও তাদের কেউ কেউ এক সময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মামলার তদন্তের সঙ্গে একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানান।
হোসেনী দালানে বোমা হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে মুসয়াবসহ চারজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন আরও নয়জন। আরও অন্তত দু’জনকে খোঁজা হচ্ছে।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির ডিসি (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, হোসেনী দালানে বোমা হামলা মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই চার্জশিট দেওয়া হবে।ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান এডিসি ছানোয়ার হোসেন বলেন, হোসেনী দালানে যে ধরনের হ্যান্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল, একই ধরনের গ্রেনেড মিরপুরের আস্তানা থেকে উদ্ধার করা হয়। মিরপুরের বাসায় তারা হ্যান্ড গ্রেনেড তৈরি করে সারাদেশে সরবরাহ করত।গত বছরের ২৩ অক্টোবর রাতে হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি জমায়েতে বোমা ছোড়া হয়। এতে দু’জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। বোমা হামলার ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ তাদের ওয়েবসাইটে দাবি করে- আইএস এ হামলার ‘দায়’ স্বীকার করেছে। তবে পুলিশের তদন্তে এ ঘটনায় আইএস জড়িত থাকার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি ভিন্ন খাতে নিতে আইএসের নাম ব্যবহার করা হয়েছে।যারা আসামির তালিকায় :হোসেনী দালানে বোমা হামলার মামলায় আসামির তালিকায় রয়েছেন অন্তত ১০ জন। তারা হলেন- মাসুদ রানা ওরফে সুমন ওরফে রিফাত ওরফে রাসেল, চান মিয়া, ওমর ফারুক ওরফে মানিক, হাফেজ মাহমুদ ওরফে আহসান উল্লাহ মাহমুদ, শাহজালাল, কবির হোসেন ওরফে রাশেদ, আবু সাইদ ওরফে সালমান, আরমান ওরফে মনির, জাহিদ হাসান রানা ওরফে মুসয়াব প্রমুখ। তাদের মধ্যে ফিদাইল হলেন- মাসুদ রানা, রাশেদ ও মুসয়াব। অন্যরা ‘ইসহাব’ হিসেবে পরিচিত। যারা সংগঠনে নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের ইসহাব বলা হয়। জেমবির তিনজন সামরিক কমান্ডার হোজ্জা, আবদুল্লাহ ওরফে নোমান ও হিরন হোসেনী দালানে বোমা হামলায় জড়িত ছিলেন। ডিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সংগঠনটির এই তিন সামরিক কমান্ডার নিহত হওয়ায় তাদের চার্জশিটে আসামি করা হচ্ছে না। হোসেনী দালানে যারা হামলা চালান তাদের মধ্যে হোজ্জা, আবদুল্লাহ, নোমান ও হিরন আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় জড়িত ছিলেন। একই গ্রুপের সদস্যরা পুলিশ চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে ছিলেন।দুই মাসের পরিকল্পনা :মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা জানান, দুই মাস ধরে পরিকল্পনা করে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি সমাবেশে হামলা চালানো হয়।
পরিকল্পনাকারীদের ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিল। ঢাকা, বগুড়া, আশুলিয়া ও গাজীপুরে এই গ্রুপের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বগুড়ায় জেএমবির সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন হোজ্জা। আশুলিয়ায় প্রশিক্ষণ দেন নোমান। এ ছাড়া হোসেনী দালান এলাকা রেকি করতে জেএমবির সদস্যরা মোহাম্মদপুর ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় বাসা ভাড়া নেন।কামরাঙ্গীরচর এলাকার বাসিন্দা আরমান ও মুসয়াব বাসা ভাড়ার বিষয়টি দেখভাল করেন। পরিচয় লুকাতে জেএমবির সদস্যদের একাধিক ছদ্মনাম দেওয়া হয়। এমনকি প্রতিটি গ্রুপের হাতে দেওয়া হয় পাঁচটি করে হাত বোমা। ঘটনার রাতে জড়িতরা হোসেনী দালানের ভেতরে-বাইরে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত হয়ে জড়ো হন। পাঁচটি বোমা নিক্ষেপের পর তিনটি বিস্ফোরিত হয়, বাকিগুলো অবিস্ফোরিত ছিল। সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়- হোসেনী দালানের কবরস্থানের ভেতরে থেকে এক ব্যক্তি প্রথমে দুটি বোমা ছোড়েন। এর অল্প সময় পরই আরও তিনটি বোমা ছোড়া হয়। ছোড়ার আগে তাকে হাত বোমার পিন খুলতে দেখা যায়। পাশেই সন্দেহভাজন আরেক ব্যক্তি ছিলেন।
যেভাবে রহস্য উদ্ঘাটন: গাবতলীতে পুলিশ চেকপোস্টে এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে হত্যার পর সেখান থেকে হাতেনাতে আটক করা হয় এক যুবককে। পরে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা যায় তার নাম মাসুদ রানা ওরফে এনামুল। মাসুদ এক সময় বগুড়ার আদমদীঘি থানা ছাত্রশিবিরের নেতা ছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে রহস্যের জট খুলতে থাকে হোসেনী দালানে বোমা হামলার। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, যারা জেএমবির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সহায়তা করেছেন তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। জেএমবির বোমা তৈরির আরও কয়েকজন কারিগরকে খোঁজা হচ্ছে। হোসেনী দালানে বোমা হামলায় জড়িতদের পরিচিত আরেকটি গ্রুপ চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর মসজিদে বোমা হামলায় জড়িত ছিল।