চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের যন্ত্রপাতি কেনাকাটা-সংক্রান্ত কার্যাবলি আটকে আছে ১৫টি প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেটে। গত ছয় বছরে বন্দরের জন্য ৮০০ কোটি টাকায় কেনা দেড় শতাধিক যন্ত্রপাতির প্রতিটি টেন্ডারে ঘুরেফিরে এসব প্রতিষ্ঠানই অংশ নিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে টেন্ডার হওয়ার পরও এই ১৫ প্রতিষ্ঠানের বাইরে কার্যাদেশ পায়নি কেউই। অভিযোগ উঠেছে, বন্দর কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানীয় এজেন্টরা শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন এবং টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছেন।
ব্রিটেনের লিনডে হেভি ট্রাক ডিভিশন ২০১০ সালে ১৫ লাখ ৯৩ হাজার ইউরো মূল্যের লোড কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পাঁচটি এফএলটি এবং ১৪ লাখ ৭৫ হাজার ডলার মূল্যের পাঁচটি আরএসটির কার্যাদেশ পায়। এ প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এজেন্ট ঢাকার পেট্রোলা ট্রেডিং করপোরেশন।
থাইল্যান্ডের টিসিএম এশিয়া ডিস্ট্রিবিউশন ও ইতালির পিসি প্রোডুজিওনির স্থানীয় এজেন্ট এমএনএস ইকুইপমেন্ট সার্ভিস। প্রথম প্রতিষ্ঠানটি ২০১১ সালে ২ কোটি ৫২ লাখ ইয়েনের ৩টি ফর্ক লিফট ও দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ সালে ৫ লাখ ৩ হাজার ডলারের দুটি মোবাইল ক্রেন সরবরাহের কার্যাদেশ পায়। কোরিয়ার হুন্দাই হেভি ইন্ডাস্ট্রিজের স্থানীয় এজেন্ট এইচএনএস অটোমোবাইলস। এ প্রতিষ্ঠান ২০১২ সালে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ডলার ও এক লাখ ৭ হাজার ডলারের মোট তিনটি ফর্ক লিফট সরবরাহের কার্যাদেশ পায়। ২০১২ সালে ৪৭ লাখ ৭৭ হাজার ইউরোর দুটি মোবাইল হার্বার ক্রেন সরবরাহের কার্যাদেশ পেয়েছে অস্ট্রিয়ার লিবার ওয়েক নেনজিং। এ প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এজেন্ট ঢাকার এজে করপোরেশন। ডাচ লঙ্কা ট্রেইলরের স্থানীয় এজেন্ট ঢাকার ইকম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩ সালে ২৬ লাখ ৮৮ হাজার ডলারের ১০টি মোবাইল ক্রেন সরবরাহের কাজ পেয়েছে। জাপানের ট্রেডানো লিমিটেডের স্থানীয় এজেন্ট চট্টগ্রামের কিং শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি। ২০১৩ সালে এ প্রতিষ্ঠানটি ১০ কোটি ৬৯ লাখ ইয়েনের দুটি মোবাইল ক্রেন সরবরাহের কার্যাদেশ পায়।
ফিনল্যান্ডের কার্গোটেক কোম্পানি ২০১১ সালে ৪৪ লাখ ৬১ হাজার ইউরোর চারটি আরটিজি, ২০১২ সালে খালি কনটেইনার ওঠানো-নামানোর চারটি আরএসটি ও ২০১৩ সালে ৪৬ লাখ ৮ হাজার ইউরোর চারটি আরটিজি সরবরাহের কাজ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় এজেন্ট সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। সিঙ্গাপুরের কার্গোটেক সিএইচএস এশিয়া প্যাসিফিক লিমিটেড ও ফিনল্যান্ডের কার্গোটেক সলিউশনেরও স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে সাইফ পাওয়ারটেক। প্রথম প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩ সালে ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ডলার মূল্যের ২টি স্ট্রাডল ক্যারিয়ার সরবরাহ করেছে। দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ সালে ১০ লাখ ৭৯ হাজার ইউরোর চারটি আরএসটি সরবরাহের কার্যাদেশ পায়। হংকংয়ের কার্গো টেক এশিয়া লিমিটেড ২০১০ সালে ৯৩ লাখ ৯৮ হাজার ইউরোর তিনটি কনটেইনার মুভার এবং মেনিটওক ক্রেন গ্রুপ ২০১১ সালে ১৯ লাখ ১৬ হাজার ও ১২ লাখ ৮ হাজার ডলারে মোট ৫টি মোবাইল ক্রেন সরবরাহের কার্যাদেশ পায়। তখন এটির স্থানীয় এজেন্ট ঢাকার গ্যাঞ্জেস লিমিটেড থাকলেও বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানেরও স্থানীয় এজেন্ট সাইফ পাওয়ারটেক। কোরিয়ার দাইয়ু ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনেরও স্থানীয় এজেন্ট সাইফ পাওয়ারটেক। এ প্রতিষ্ঠান ২০১১ সালে ৩ লাখ ৮২ হাজার ডলারের ১০টি, ২০১২ সালে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ডলারের ২০টি ও ২০১৩ সালে ২ লাখ ৭৪ হাজার ডলারের ১৫টি লো মাস্ট ফর্ক লিফট সরবরাহের কাজ পেয়েছে।
মান বাড়ছে উপঢৌকনে :কলম্বো, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের স্বীকৃত বন্দরে যন্ত্রপাতি কেনার আগে তা আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণী সংস্থার মাধ্যমে যাচাই করা হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে যেসব প্রতিষ্ঠান যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে তারা স্থানীয় কর্মকর্তাদের বিদেশ নিয়ে যাচ্ছেন এ কাজে। আবার বন্দরের অবসরপ্রাপ্ত অনেক কর্মকর্তাকে চাকরিও দিয়েছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট সংস্থাগুলো। যেমন_ চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য বিদায়ী প্রধান প্রকৌশলী বর্তমানে সাইফ পাওয়ারটেকের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিদেশ ভ্রমণ কিংবা অবসরের পর চাকরি_ এ দুটি উপঢৌকনের পাশাপাশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কমিশনও নিচ্ছেন বন্দরের কিছু প্রকৌশলী। যেকোনো ব্যাপারে তাই সিদ্ধান্তও দিচ্ছেন সরবরাহকারীদের চাহিদা অনুযায়ী।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালে ইতালির একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তিন কোটি টাকায় কেনা হয় তিনটি ‘পিক এন ক্যারি ক্রেন’। এসব যন্ত্র গত এক দশকে একবারের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি। অথচ বন্দর থেকে বিশেষজ্ঞ দল বিদেশ গিয়ে এ তিনটি সরঞ্জাম কেনার পক্ষে মত দেয়। পরে জানা যায়, এ ধরনের ক্রেন দিয়ে করার মতো কাজই হয় না চট্টগ্রাম বন্দরে।
অন্যদিকে ২০১২ সালে দরপত্রের মাধ্যমে ১০টি পাঁচ টন ক্ষমতার ফর্কলিফট যন্ত্র সরবরাহ করে কোরিয়ার দাইয়ু ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন। এসব যন্ত্র পরিদর্শনের জন্য কোরিয়া সফর করেন বন্দরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম এবং সহকারী প্রকৌশলী আসিফ মাহমুদ। সে সময় তাদের দেওয়া প্রতিবেদন বলছে, চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রপাতি সন্তোষজনক অবস্থায় পাওয়া গেছে। এই যন্ত্র চট্টগ্রাম বন্দরে নামানোর পর আরেক দফা পরিদর্শন করে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) খায়রুল মোস্তফার নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি। তখন তারা এসব যন্ত্রে একাধিক গরমিল খুঁজে পান। তারপরও ফর্ক লিফটগুলো কেনা হয়েছে।
এর আগে ২০১০ সালে তুরস্কে বর্জ্য অপসারণের জাহাজ পরিদর্শনে সাতটি ত্রুটি চিহ্নিত করে এসব সংশোধনের পর জাহাজটি বন্দরে আনার সুপারিশ করেন বন্দরে সফরকারী কর্মকর্তারা। কিন্তু অন্য একটি দলের সুপারিশে সংশোধন ছাড়াই জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে আনা হয়। বর্জ্য অপসারণের কাজে এ জাহাজটি যথাযথভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিন্ডিকেটের হাতে যাচ্ছে আরও ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার কাজ :চলতি অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য ১১০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজও পাচ্ছে ১৫ প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট। এরই মধ্যে ১০ টন ধারণক্ষমতার ৪টি ফর্ক লিফট, ৪০ টন ধারণক্ষমতার ২টি আরটিজি ও ১টি হাইড্রোলিক এক্সক্যাভেটর সরবরাহের কাজ পেয়েছে যথাক্রমে সেই সিন্ডিকেটে থাকা জাপানের ট্রেডানো লিমিটেড, কার্গোটেক এশিয়া লিমিটেড ও সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড।
সংশ্লিষ্টরা যা বললেন :সম্প্রতি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর সফরে এসে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, ‘বন্দরের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে শিগগির ই-টেন্ডারিং চালু হবে। এর যাবতীয় প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। সিন্ডিকেট করে কেউ যেন যন্ত্রপাতি কিনতে না পারে সে ব্যাপারে নজরদারি করা হবে।’ বন্দর-পতেঙ্গা আসনের সাংসদ এমএ লতিফ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বন্দরের কেনাকাটা প্রক্রিয়ায় গলদ রয়েছে। এ জন্য ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার একটি টেন্ডার কার্যক্রম স্থগিতও করেছি। আবার সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে বন্দরে গিয়ে নথিপত্রও দেখেছি।’
চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘যন্ত্রপাতি ক্রয়ে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। একাধিক কমিটি যাচাই-বাছাই করে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দিয়েছে।’ যন্ত্রপাতি সরবরাহকারীর টাকায় কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের বিষয়টি পিপিআরে উল্লেখ রয়েছে বলেও জানান তিনি। বিদেশি কার্গোটেক কোম্পানির দেশীয় এজেন্ট সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন বলেন, ‘বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কমিশনের ভিত্তিতে আমরা ডিস্ট্রিবিউটরশিপ নিই। বন্দরের কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে কিংবা উপঢৌকন দিয়ে কার্যাদেশ নেওয়া যায় না।’ বিশ্বে বড় যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হাতেগোনা কয়েকটি থাকায় বন্দরের টেন্ডারেও অংশগ্রহণকারী কম থাকে বলে মন্তব্য করেন তিনি।