জাতিসংঘে মিতার নতুন মিশন

Slider নারী ও শিশু

untitled-2_189475

 

 

 

 

 

ছয় বছর ধরে গাড়ির স্টিয়ারিং নিখুঁতভাবে সামলে অনেকবার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশংসা পেয়েছেন পুলিশ কনস্টেবল মিতা রানী বিশ্বাস। তবে এবার তার গাড়ি চালানোর প্রশংসা করলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুলিশ সপ্তাহ-২০১৬ উপলক্ষে গত মঙ্গলবার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে বার্ষিক প্যারেড পরিদর্শনে গাড়ি চালানোর দায়িত্ব পড়ে মিতার ওপর। আর এতেই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন তিনি। বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সফলভাবে প্যারেড পরিদর্শন গাড়ি চালালেন কোনো নারী পুলিশ সদস্য। ওই দিন কুচকাওয়াজ পরিদর্শন শেষে গাড়ি থেকে নেমেই প্রধানমন্ত্রী চালক মিতার পাশে গিয়ে বললেন, ‘তুমি অনেক সুন্দর গাড়ি চালিয়েছ। থ্যাঙ্ক ইউ।’

এরই মধ্যে কনস্টেবল মিতা মনোনীত হয়েছেন কঙ্গোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নারী কন্টিনজেন্টের সদস্য হিসেবে কাজ করার। কঙ্গো যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছেন তিনি। এখন মিতার স্বপ্ন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়ে শান্তিরক্ষীদের গাড়ি চালানো। সেখানেও সাহস ও কৃতীর নজির স্থাপন করতে চান তিনি।
মিতা এখন সত্যি ইতিহাসের অংশ। তার জন্য গর্ব করছে গোটা পুলিশ বাহিনী। আর সন্তানের এমন কৃতী টেলিভিশনের পর্দায় দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি তার মা-বাবা। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর পরই
ঝিনাইদহ সদরের চাকলাপাড়া থেকে এলো মিতার বাবা মদন মোহর বিশ্বাসের ফোন। বাবা আর মেয়ের মধ্যে কথা হলো সামান্যই। তবে ফোনের ওপাশ থেকে ডুকরে ডুকরে কাঁদলেন মদন মোদন। মিতার বুঝতে কষ্ট হলো না_ এই কান্না বেদনার নয়; এই কান্না গর্বের! মেয়ের জন্য গর্বে বুক ভরে উঠছে মা অঞ্জলী রানী বিশ্বাসেরও। শুধু প্যারেড পরিদর্শন গাড়ির চালক নারী নন, এবারের পুলিশ সপ্তাহে প্যারেডের নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন নারী। তিনি চাঁদপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার।
গতকাল দুপুরে রাজারবাগে মিতা রানী বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। মিতা জানালেন, ২০০৭ সালে পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল হিসেবে যোগ দেন তিনি। ২০০৯ সালে ডিএমপির ট্রান্সপোর্ট শাখায় তার স্থায়ী পোস্টিং হয়। ওই সময় ঢাকা মহানগর পুলিশের ১৫ জন নারী কনস্টেবলকে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে ১৪ জনই পদোন্নতি পেয়ে অন্য বিভাগে চলে যান। মিতা একাই গাড়িচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বার্ষিক প্যারেডে গাড়ি চালানোর দায়িত্ব পালনের জন্য তাকে নির্বাচিত করার পর কয়েকদিন চলে মহড়া। নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল তাকে পারতে হবেই। সেটা ভালোভাবে শেষ করতে পেরে অত্যন্ত খুশি তিনি।
মিতা জানালেন, প্যারেড পরিদর্শন শেষে গাড়ি থেকে নামার পরই প্রধানমন্ত্রী তাকে ধন্যবাদ জানান। পরে সহকর্মীরা ধন্যবাদ জানান। প্যারেডে গাড়ি চালানোর পর থেকে চারপাশের পৃথিবীটা পাল্টে গেছে। কেউ কেউ দেখলে এখন বলছেন, ‘এটা আমাদের মিতা না!’ প্যারেড অনুষ্ঠানে চারদিকে এত লোকজন, এত ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, এত নিরাপত্তাব্যুহ_ কোনো কিছুই মাথায় ছিল না। তার একটাই চিন্তা ছিল_ মেয়েরাও পারে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী; স্পিকার নারী। বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী উপাচার্যও রয়েছেন। আমি কেন নারী হয়ে প্যারেডে গাড়ি চালাতে পারব না!

মিতা জানান, তার বাবা পেশায় চাল ব্যবসায়ী। মা গৃহিণী। চার বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। মিতার দুই বোন শিক্ষক ও ছোট বোন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়াশোনা করছেন। মিতা এখন গাড়ি চালাচ্ছেন উইম্যান সাপোর্ট অ্যান্ড ভিকটিম সেন্টারের ডিসি ফরিদা ইয়াসমিনের। এসএসসি পরীক্ষায় পাসের পরই পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। বর্তমানে ঢাকার একটি কলেজে মাস্টার্সে পড়াশোনা করছেন।
পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পেছনের গল্পটাও জানালেন এই কৃতী নারী কনস্টেবল। তিনি জানান, ঝিনাইদহ জেলা একসময় প্রতিদিন লাশ পড়ত। সর্বহারা পার্টির আতঙ্কে এলাকাবাসী ঠিকমতো ঘুমাতে পারত না। এরপর সর্বহারা পার্টির বিরুদ্ধে ঝিনাইদহে কঠোর অভিযান শুরু করে পুলিশ-র‌্যাব। এলাকার পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত হয়। সর্বহারা পার্টির নির্যাতন দেখে পুলিশ বাহিনীতে যোগদানের আগ্রহ হয় মিতার। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হয়ে এলাকার লোকজনের নিরাপত্তার জন্য কিছু করার ইচ্ছা তার।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে জানতে চাইলে মিতা জানান, কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী মিশনে নারী কন্টিনজেন্টের সদস্য হিসেবে যাচ্ছেন তিনি। এরই মধ্যে মনোনীতদের তালিকায় তার নাম উঠেছে। শান্তিরক্ষী মিশনে গিয়ে শান্তিরক্ষীদের গাড়ি চালাতে চান তিনি। ভবিষ্যতে পুলিশ বাহিনীর সদস্য হিসেবে সাধারণ মানুষের জন্য নিরলসভাবে কাজ করতে চান। পুলিশের কাছ থেকে যাতে কোনো নিরপরাধ মানুষ কোনো কষ্ট না পান, এটাও তার চাওয়া।
ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার সমকালকে বলেন, পুলিশের ইতিাসে প্রথমবারের মতো একজন নারী প্যারেড পরিদর্শন গাড়ি চালালেন। এ ছাড়া প্যারেডে নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন নারী। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতির এটি একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
ডিএমপির ট্রান্সপোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম স্বপন বলেন, পুলিশ বাহিনীতে এখন একমাত্র নারী গাড়িচালক মিতা। মিতা এখন গোটা পুলিশের জন্য গর্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *