কিবরিয়া হত্যার বিচার ১১ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি

Slider জাতীয়

 

Bochor_e_o_alur_mukh_dekheni_kibriya_460504413

 

 

 

হবিগঞ্জ: ২৭ জানুয়ারি। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ড তথা ‘বৈদ্যের বাজার ট্র্যাজেডি’র এগারতম বার্ষিকী। হত্যাকাণ্ডের ১১ বছর পূর্ণ হয়েছে আজ (বুধবার)। এতোবছর পার হলেও আলোর মুখ দেখেনি কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার।

এরইমধ্যে কিবরিয়া হত্যার ঘটনায় দায়ের করা হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা দু’টির অভিযোগপত্র আমলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য নেওয়া শেষ না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হত্যা মামলাটি স্থগিত রাখা হয়েছে।

বিস্ফোরক মামলাটি হবিগঞ্জ দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ আদালতের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে।

২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঈদ পরবর্তী এক জনসভা শেষে বের হওয়ার পথে গ্রেনেড হামলার শিকার হন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া।

এ নির্মম হামলায় তিনি গুরুতর আহত হলে চিকিৎসার জন্য ঢাকা নেওয়ার পথে রক্তক্ষরণজনিত কারণে মারা যান।

এই হামলায় আরও নিহত হন তার ভাতিজা শাহ মঞ্জুরুল হুদা, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী।

আহত হন হবিগঞ্জ-৩ (হবিগঞ্জ সদর-লাখাই) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু জাহির এবং সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আলমগীর চৌধুরী ও রাজন চৌধুরীসহ অর্ধশতাধিক লোক।

এ ঘটনায় ২০০৫ সালের ২৮ জানুয়ারি হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলা দায়ের করেন।

মামলা দায়েরের পরপরই রহস্যজনক কারণে তখনকার পুলিশ সুপার আবু মুসা মো. ফখরুল ইসলাম এবং হবিগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) ইনাম আহমেদ চৌধুরীকে প্রত্যাহার করা হয়।

এরপর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডি’র তখনকার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিকুর রহমানকে। মুন্সি আতিক যেন-তেনভাবে ২০০৫ সালের ১০ মার্চ ১০ জনকে অভিযুক্ত করে বিচারিক আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

ওই প্রতিবেদনের অভিযুক্তরা হলেন, তখনকার সময়ে শহীদ জিয়া স্মৃতি ও গবেষণা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি এ কে এম আব্দুল কাইয়ূম, যুবদল নেতা জয়নাল আবেদীন জালাল, জমির আলী, তাজুল ইসলাম, জয়নাল আবেদীন মুমিন, সাহেদ আলী, সেলিম আহমেদ, আয়াত আলী, মুহিবুর রহমান ও কাজল মিয়া।

প্রতিবেদন দাখিলের দিনই আদালতে নারাজি পিটিশন দাখিল করেন মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান। আদালত এ আবেদন খারিজ করে দেন। এরপর একই বছরের ১০ মে মামলার শুনানির তারিখ ধার্য্য হয়।

কিন্তু মামলার বাদীর নারাজির পিটিশন বাতিল হলে তারা হাইকোর্টে আপিল করেন। হাইকোর্ট এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করেন।

সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল মুন্সি আতিকের দাখিলকরা চার্জশিট থেকেই বিচার কাজ শুরু করতে চাইলে মামলার বাদী বর্ধিত ও অধিকতর তদন্তের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু বিচারক বিপ্লব গোস্বামী সেই আবেদনও খারিজ করে দেন।

আবেদনটি খারিজ হলে মামলার বাদী হাইকোর্টে রিভিশন লিভ টু আপিল দায়ের করেন।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হাইকোর্ট দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ মামলাটির অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। মুন্সি আতিক অবসরে চলে যাওয়ায় সিআইডি’র এএসপি রফিকুল ইসলামকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।

বর্ধিত তদন্তকালে মামলাটি নতুন মোড় নেয়। এর সঙ্গে জঙ্গি মিজান ও মুফতি হান্নানসহ জঙ্গি চক্রের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। মুন্সি আতিকের দেওয়া অভিযুক্ত ১০ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া না গেলে তারা জামিনে মুক্ত হন।

২০১১ সালের ২০ জুন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, মুফতি হান্নানসহ ২৪ জনকে আসামি করে অধিকতর তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি রফিকুল ইসলাম ৪ বছর অধিকতর তদন্ত শেষে হবিগঞ্জ জুডিশিয়াল বিচারিক আদালতে এই প্রতিবেদন দাখিল করেন।

২৮ জুন কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া প্রতিবেদনের উপর হবিগঞ্জের বিচারিক আদালতে নারাজির আবেদন করেন।

আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার মূল নথি সিলেট দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে থাকায় বিচারক রাজিব কুমার বিশ্বাস উপ-নথির মাধ্যমে আবেদনটি সিলেটে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন নারাজির আবেদন গ্রহণ করেন সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার দেবনাথ।

তিনি ওইদিনই সিআইডির সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে মামলার অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। পরে ওই বছরের জানুয়ারি থেকে সিআইডির এএসপি মেহেরুন নেছা পারুল অধিকতর তদন্ত শুরু করেন।

২০১৪ সালের ৩ ডিসেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা মেহেরুন নেছা পারুল নতুন ১১ জনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-১ এর বিচারক রোকেয়া আক্তারের আদালতে তৃতীয় দফায় অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

ওই প্রতিবেদনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, সিলেট সিটি করপোরেশন মেয়র (বরখাস্ত) বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী ও হবিগঞ্জ পৌরসভা মেয়র (বরখাস্ত) জেলা বিএনপি সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

এ সময় আদালত আরিফুল হক চৌধুরী ও জি কে গউছের নাম ঠিকানা ভুল থাকায় প্রতিবেদন গ্রহণ না করে নামঠিকানা সংশোধন করে পুনরায় ২১ ডিসেম্বর চতুর্থ দফার অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।

পরে ২১ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-২ এর বিচারক রশিদ আহমেদ মিলনের আদালত চতুর্থ দফায় অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে হারিছ চৌধুরী, আরিফুল হক চৌধুরী ও জি কে গউছসহ ১০ পলাতক আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।

২৮ ডিসেম্বর বিএনপি নেতা জি কে গউছ ও ৩০ ডিসেম্বর আরিফুল হক চৌধুরী হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-১ এর বিচারক রোকেয়া বেগমের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন প্রার্থনা করেন। বিচারক তাদের জামিন আবেদন না-মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীসহ ১০ পলাতক আসামির বিরুদ্ধে ক্রোক পরোয়ানা জারি করেন হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রশিদ আহমেদ মিলন।

পলাতক অপর আসামিরা হলেন- মওলানা তাজউদ্দিন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল মিয়া, মওলানা ইয়াহিয়া ও আব্দুল জলিল।

এদিকে, এ বছরের ৫ জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেলা দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আতাব উল্লাহ কিবরিয়া হত্যার বিস্ফোরক মামলায় ৩৫ জনের মধ্যে ৩২ জন আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে (কগনিজেন্স) নেন। আসামিদের মধ্যে জেলে রয়েছে ১৪ জন, জামিনে ৮ এবং পলাতক রয়েছেন ১০ জন।

এর মধ্যে আসামি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখার আবু বকর, চট্টগ্রামের ইউসুফের নাম-ঠিকানা ভূয়া থাকায় এবং ফরিদপুর জেলার চৌরঙ্গীমুখর এলাকার আহসান উল্লাহ ২০০৬ সালে ভারতে পুলিশের এনকাউন্টারে মারা যাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আমল গ্রহণ করা হয়নি।

এ ব্যাপারে মামলা দু’টির বাদী হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান  জানান, বর্তমান সরকারের আমলেই মামলা দু’টির বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।

মরহুম শাহ এ এম এস কিবরিয়া ১৯৩১ সালে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার রুস্তমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *