ঢাবি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে প্রস্তাবিত মেট্রোরেলের রুট নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আলাদা-আলাদা কর্মসূচিও পালন করছেন তারা। বুধবারও শিক্ষার্থীরা পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করেছে। এসব কর্মসূচিতে ঢাবির ভেতর দিয়ে মেট্রোরেলের রুট করার পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেলের রুটটি শাহবাগ থেকে চারুকলা হয়ে টিএসসি রাজু ভাস্কর্য ঘুরে দোয়েল চত্বর হয়ে প্রেসক্লাবের দিকে যাবে। টিএসসি এবং দোয়েল চত্বরের মাঝে একটি স্টেশন থাকবে।
প্রস্তাবিত মেট্রোরেলের রুটের উচ্চতা হবে ৩০ মিটার। এছাড়া প্রতিটি স্টেশনের দৈর্ঘ্য হবে ১৮০ মিটার ও প্রস্থ ২০-২৬ মিটার।
মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য এইসিএল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এইচ হক এর নেতৃত্বে ১২জন গবেষক একটি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে করে। গত বছরের মাঝামাঝিতে এই হিস্টোরিকাল ইমপরট্যান্স বা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের খসড়া রিপোর্ট পেশ করেন গবেষক দল। সার্ভেতে ঢাকা শহরের বুদ্ধিজীবী, স্থপতি, ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিকদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। তারা তখন পরামর্শ দিয়েছিলেন, ন্যাশনাল রেকর্ড প্রত্নতত্ত্ব এবং ঐতিহাসিক মূল্য বিবেচনায় টিএসসি-দোয়েল চত্বর দিয়ে রুট না নিয়ে শাহবাগ-মৎস্য ভবন দিয়ে নেয়ার জন্য।
এর ভিত্তিতে ‘মেট্রোরেলের রুট বদলাও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয বাঁচাও’ ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে প্রস্তাবিত রুট বদলের আন্দোলন শুরু করেছে। এতে সংহতি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেড়ারেশন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ বাম ছাত্র সংগঠনগুলো।
১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় মেট্রোরেলের রুট বদলের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এই প্রজেক্ট আমরা শুরু করেছি- সেটা বাধাগ্রস্ত করা মানে সেটার কাজ সেখানে মুখ থুবড়ে পড়বে। যাদের কাছ থেকে আমরা অর্থ ধার নিচ্ছি, তারা অর্থ দেয়া বন্ধ করে দেবে। আর উন্নয়নটা হবে না। এই উন্নয়নটা বন্ধ করা উদ্দেশ্য কি না!
এর প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ১৪ জানুয়ারি মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি পাঠ করেন। চিঠিতে তারা বলেন, আন্দোলন কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রের উন্নয়নের বিপক্ষে নয়। আমরা মেট্রোরেলের বিপক্ষে নই। তবে সেটা যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুক চিড়ে না হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের বিষয়ে খণ্ডিত বক্তব্য পৌঁছেছে।
তারা আরো বলেন, ঐতিহাসিক মোঘল স্থাপনা মীর জুমলা গেটের (ঢাকা গেট) উপর দিয়ে এবং সন্ত্রাসবিরাধী রাজু ভাস্কর্যের একেবারে গা ঘেঁষে মেট্রোরেলের লাইন যাবে। তিন নেতার মাজারও সেখানে রয়েছে। এতে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর ত্রিমাত্রিক সৌন্দর্য যেমন নষ্ট হবে, তেমনি প্রতি সাড়ে তিন মিনিট অন্তর মেট্রোরেলের যাতায়াতে সৃষ্ট কম্পনে স্থপানাগুলোর স্থায়িত্বও হুমকির মুখে পড়বে।
রুট বদলের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, মেট্রোরেলের স্টেশন ক্যাম্পাসের ভেতর করলে এর নিচের অংশ অনেক সঙ্কীর্ণ হয়ে যাবে। ফলে যানজট তৈরি হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসে মেট্রোরেলের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়।
এদিকে এর আগে মেট্রোরেলের পক্ষে মানববন্ধন শেষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের কাছে স্মারকলিপি দেন ক্ষণিকা, চৈতালী ও বৈশাখী রুটে যাতায়াতকারী শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, মেট্রোরেল ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে হলে উত্তরা, টঙ্গী থেকে আসতে আমাদের ১০ মিনিট লাগবে। অনেক সময় বেঁচে যাবে।
একই দিন ছাত্র ইউনিয়ন মেট্রোরেলের রুট বদলের দাবিতে ক্যাম্পাসে মিছিল করে এবং উপাচার্যকে স্মারকলিপি দেয়।
মেট্রোরেলের কারণে ঐতিহাসিক স্থপানাগুলোর কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল। তিনি বলেন, মেট্রোরেলের ফলে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো অ্যাফেক্টটেড হবে না। আমি কলকাতায় দেখেছি মেট্রোরেলের পাশেই অনেক অফিস রয়েছে। এতে ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধা হবে না।
স্টেশন হলে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তায় ব্যাঘাত ঘটবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোনো কারণ নাই। আমাদের ক্যাম্পাসে তো বহিরাগত প্রবেশে কোনো সীমাবদ্ধতা নাই। দোয়েল চত্বর এলাকায় আগে থেকেই জ্যাম লেগে থাকে দোকান থাকার কারণে। আর মেট্রোরেল রাস্তার উপর দিয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা যা একবার বিমান বাহিনীর বিরোধিতার কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এখন আবার নতুন করে রুট পরিবর্তন করা হলে এটা অনেক দূর পিছিয়ে যাবে। এটা এমন কোন বড় বিষয় নয় যে রুট পরিবর্তন করতে হবে।
সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা মেট্রারেল ঢাকাবাসীর জন্য খুব ভালো উদ্যোগ বলে বর্ণনা করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে রুট করার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ঢাকার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি ঐতিহাসিক স্থাপনা অবস্থিত। এর ফলে এই ঐতিহাসিক স্থপনাগুলো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে এক্সপার্টদের রিপোর্টে। ক্ষতিটা শব্দ দূষণের জন্য নয়, কম্পনের জন্য। যখন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবা উচিত ছিল। সেই হিসেবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. দেলওয়ার হোসেন খান মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, এর ভালো মন্দ দুই দিক রয়েছে। ছাত্ররা কম সময়ে ট্রেনে যেতে পারবে, তাদের জ্যামে পডতে হবে না। অসুবিধা হতে পারে স্টেশন হলে কারণ তখন অনেক লোকের আনাগোনা হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে দূরে থাকা ভালো।
তবে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, মেট্রারেলের পক্ষে ছাত্রছাত্রীরা মানববন্ধন করেছে, পরে তারা স্মারকলিপি দিয়েছে। তারা মেট্রোরেল চায়, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের সস্তায় সহজে গণপরিবহনের সুযোগ দিতে হবে। এই বিষয়গুলো তারা বলে গেছে।
রুট বদলানোর দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা কতকগুলো সমস্যার কথা উল্লেখ করে স্মারকলিপি দিয়েছে। আমরা সেইগুলো কর্তৃপক্ষের নিকট জানাব।
তিনি বলেন, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এসব নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেসময় তারা জানিয়েছে, ট্রেনের লাইনটি চল্লিশ ফুট ওপর দিয়ে যাবে এবং শব্দ ও কম্পনহীনভাবে চলাচলের বিষয় পুরোপুরি নিশ্চিত করা হবে। এক্ষেত্রে সর্বশেষ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ।