আবারও ভাঙনের মুখে পড়েছে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার ভাই জিএম কাদেরকে জাপার কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করার ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন তারা অনুসারীরা। সোমবার জাপার সরকার সমর্থক এমপি ও নেতাদের ‘যৌথ সভা’ শেষে এরশাদপত্নী রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। এরশাদ বলেছেন, এ ঘোষণা গঠনতন্ত্রবিরোধী। এর বিরুদ্ধে তিনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন।
গত রোববার কট্টর সরকারবিরোধী জিএম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান করেন এরশাদ। ঘোষণা দেন- তার অবর্তমানে কাদেরই হবেন দলের নেতা। সত্যিকারের বিরোধী দল হতে তিনি মন্ত্রী পদমর্যাদার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদও ছাড়তে চান। মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসবে তার দল। কাদের দায়িত্ব পেয়েই বলেন, জাপা এমপিদের মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হবে। নয়তো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর পর থেকেই তোলপাড় শুরু হয় জাপায়। দলে সক্রিয় সরকারপন্থি ও সরকারবিরোধী পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। রওশন ও কাদেরের ব্যক্তিগত পর্যায়ের বিরোধ বহু পুরনো। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত চারবার ভেঙেছে জাপা।
রওশনকে সামনে রেখে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেওয়া নেতারা কিছুতেই মন্ত্রিত্ব ছাড়তে রাজি নন। বরং তাদের অভিযোগ, জিএম কাদেরের নিয়োগ গঠনতন্ত্রবিরোধী। মন্ত্রিত্ব ধরে রাখতে এরশাদপন্থি দুই সিনিয়র নেতা যোগ দিয়েছেন রওশনের সঙ্গে। যারা নির্বাচনের সময়ও রওশনের সঙ্গে ছিলেন। পরে তার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে গত বছর এরশাদের দিকে ভিড়েছিলেন। রওশনের পক্ষে রয়েছেন জাপার ৪০ এমপির ১৬ জন।
এরশাদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও বিএনপিবিহীন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয় জাপা। মন্ত্রিসভাতেও দলটির তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। নির্বাচন বর্জন করেছিলেন তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদেরও। যিনি নির্বাচনের পর থেকেই জাপার একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকার কড়া সমালোচক।
সোমবার বিকেলে দলের তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু, চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী দেখা করেন রওশনের সঙ্গে। তারা রওশনকে জানান, জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান পদে মানবেন না। রওশন নিজেও কাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়ার বিরোধী। রওশনের বিরোধিতার কারণে কাদেরপত্নী শেরিফা কাদের সংরক্ষিত মহিলা আসনেও এমপি হতে পারেননি।
কাদেরকে হটানোর করণীয় ঠিক করতে সন্ধ্যায় দলের এমপি ও প্রেসিডিয়াম সদস্যদের যৌথ সভা আহ্বান করেন রওশন। ১৬ এমপি ও ৫ প্রেসিডিয়াম সদস্য তাতে যোগ দেন। এ বৈঠকে রওশনকে চেয়ারম্যান করে জাতীয় পার্টি নামে নতুন দল গঠনেরও প্রস্তাব করেন এক নেতা। তবে রওশন নিজেই জাপা ভাঙার প্রস্তাবে সাড়া দেননি।
আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে পরিচিত প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলু রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব দেন। দুই নেতা বৈঠকে খোলাখুলিই বলেন, জিএম কাদেরের হাতে দলের নেতৃত্ব গেলে রওশনের ভবিষ্যৎ নেই। সরকারের সঙ্গে জাপার সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হবে। জাপা তখন রাজনীতিতে টিকতে পারবে না; বিলীন হয়ে যাবে। কট্টর কাদেরবিরোধী রওশন এতে সম্মতি দেন।
বর্তমানে রংপুরে অবস্থান করছেন এরশাদ। রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণার খবরে রাত পৌনে ১০টার দিকে তিনি বলেন, এ ঘোষণা গঠনতন্ত্রবিরোধী। যারা এ তৎপরতায় জড়িত, ঢাকায় ফিরে তাদের বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন জিএম কাদের। তিনিও একই কথা বলেন।
এরশাদ বলেন, দলের চেয়ারম্যান ছাড়া আর কেউ প্রেসিডিয়াম সভা ডাকতে পারেন না। রওশন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। তিনি পার্টির বিষয়ে কিছু করতে পারেন না। আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাই সঠিক।
রওশন ও কাদের উভয়ই এর আগে দুই দফায় জাপা থেকে বহিষ্কার হন। পরে আবার তাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
এর আগে রওশনের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেন, গঠনতন্ত্রে কো-চেয়ারম্যান পদ নেই। পার্টির চেয়ারম্যান দলীয় ফোরামে আলোচনা না করে তার আপন ভাইকে কো-চেয়ারম্যান ও উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। জিএম কাদেরকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ও এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদারকে সদস্য সচিব ঘোষণা করেন, যা গঠনতন্ত্র-বহির্ভূত।
লিখিত বক্তব্যে বাবলু বলেন, গঠনতন্ত্র সমুন্নত রাখতে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও এমপিদের যৌথ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে রওশন এরশাদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেননি। রওশন এরশাদেরও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
বাবলুর ঘোষণাকে আমলে নিতে নারাজ এরশাদপন্থিরা। দলের সাবেক মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদার সমকালকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টিতে চেয়ারম্যান একজনই। তিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি ছাড়া দলে আর কোনো নেতা নেই। রওশন এরশাদ বিরোধী দলের নেতা।’ বাবলুর কাছে মহাসচিবের পদ হারিয়ে কয়েক দিন আগেও হাওলাদার রওশনপন্থি ছিলেন।
জিয়াউদ্দিন বাবলুর সুরে সরকার সমর্থক কাজী ফিরোজ রশীদ এমপিও সমকালকে বলেন, সারাদেশের নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে রওশন এরশাদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে। মাত্র দু’দিন আগেও বাবলুর কট্টর বিরোধী ছিলেন এককালের কট্টর বিএনপিপন্থি ফিরোজ। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও বাবলু ছিলেন রওশনবিরোধী। আনিস-বাবলুর ঘোর বিরোধী ছিলেন দুই প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু ও মসিউর রহমান রাঙ্গা। কখনও একসঙ্গে দেখা যেত না তাদের। তবে এবার তারা সবাই এককাতারে দাঁড়িয়েছেন। রওশনের বাসভবনে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দলীয় এমপি মো. নোমান, নূরুল ইসলাম ওমর, সেলিম উদ্দিন, ইয়াহিয়া চৌধুরী, লিলি চৌধুরী, আমির হোসেন, ফখরুল ইমাম, নূরুল ইসলাম মিলন, খুরশিদ জাহান চৌধুরী, শওকত চৌধুরী।
বিগত মহাজোট সরকারে প্রথমে বিমান ও পরে বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন জিএম কাদের। পাঁচ বছর মন্ত্রিত্ব করলেও ২০১৩ সালে এরশাদের সমর্থনে নির্বাচন বর্জন করেন। রওশন আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর কাদের আওয়ামীবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে বিরোধে জড়ান বাবলুর সঙ্গে। গত বৃহস্পতিবার দিনাজপুরে বর্তমান সংসদকে অবৈধ বলে আখ্যা দেন। অথচ তার প্রচেষ্টাতেই ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধে জাপা। রওশন তখন বিএনপির সঙ্গে জোট চেয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি বিরোধে এর আগে চারবার ভেঙেছে জাপা। আওয়ামী লীগকে সমর্থন করায় ১৯৯৭ সালে এরশাদকে ছেড়ে জাতীয় পার্টি (জা-মো) গঠন করেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ। বিএনপির সঙ্গে জোট করায় ১৯৯৯ সালে তৎকালীন মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দল ভেঙে গঠন করেন জাতীয় পার্টি (জেপি)। ২০০০ সালে এরশাদ বিএনপির জোট ছাড়লে জাতীয় পার্টির একাংশ বিজেপি (না-ফি) জোটে থেকে যায়। ২০১৩ সালে কাজী জাফর বহিষ্কৃত হয়ে জাতীয় পার্টি (জাফর) গঠন করে বিএনপির সঙ্গে যোগ দেন।