ঢাকা: বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড আপিলেও বহাল থাকায় এ রায় কার্যকর থেকে আর মাত্র তিন ধাপ দূরে রয়েছে।
এর মধ্যে প্রথম ধাপে রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বুধবার (০৬ জানুয়ারি) দেওয়া সংক্ষিপ্ত রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ। এরপর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুর্নবিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবেন আসামিপক্ষ। রিভিউ খারিজ হলে সবশেষে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচতে নিজামীর জন্য একমাত্র সুযোগ হিসেবে থাকবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রায় পুনর্বিবেচনার(রিভিউ) আবেদনের সুযোগ পাবেন আসামি। রিভিউয়ের রায়ের ওপর ভিত্তি করে দণ্ড কার্যকর হবে। রিভিউ খারিজ হয়ে যদি ফাঁসি বহাল থাকে তাহলে বাকি থাকবে শুধু প্রাণভিক্ষা।
নিজামী রিভিউ আবেদন করবেন কি-না এ প্রশ্নের জবাবে তার প্রধান আইনজীবী আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, আগেরগুলোতে (কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, মুজাহিদ) রিভিউ করে ফল পাওয়া যায়নি। এখন এটাতে করা হবে কি-না সেটা মাওলানা সাহেব (নিজামী) জানে। রায় পর্যালোচনা করে নিজামী যদি বলেন, তাহলে রিভিউ করা হবে।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। এর প্রায় আড়াই মাস পর ওই বছরেরই ০৫ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ।
২০১৪ সালের ০৩ নভেম্বর জামায়াতের অপর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এর সাড়ে তিন মাস পর ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কামারুজ্জামানের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ।
আর জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড গত বছরের ১৬ জুন বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এর প্রায় সাড়ে তিন মাস পর ৩০ সেপ্টেম্বর তার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর আপিল মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে একই বছরের ২৯ জুলাই। আর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায় দুই মাস পরে মুজাহিদের সঙ্গে ৩০ সেপ্টেম্বর।
তারা সবাই চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে রিভিউ আবেদন করেন এবং প্রত্যেকের রিভিউ খারিজ হয়েছে। তবে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ ছাড়া আর কেউ প্রাণভিক্ষা চায়নি। কাদের মোল্লা-কামারুজ্জামানের রিভিউ খারিজের পর এবং সাকা-মুজাহিদের প্রাণভিক্ষা নাকচের পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সরকার।
ওই চারজনের পর এবার রিভিউ আবেদন করা এবং তা খারিজ সাপেক্ষে জামায়াতের আমির নিজামীর দণ্ড কার্যকরের পালা।
বুধবার সকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ একাত্তরে গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে আলবদর বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নিখিল পাকিস্তানের সভাপতি হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী কিলিং স্কোয়ার্ড আলবদর বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার ছিলেন নিজামী। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা ছাড়াও সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) হিসেবে আলবদর বাহিনী ও ছাত্রসংঘের অপরাধের দায়ও নিজামীর বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে রায়ে।
দেশের এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত এ রায় দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ। অন্য বিচারপতিরা হচ্ছেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
নিজামীকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং হত্যা-গণহত্যা ও ধর্ষণসহ সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির প্রমাণিত ৮টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে ৪টিতে ফাঁসি ও ৪টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ৩টিতে ফাঁসি ও ২টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। অন্য তিনটিতে চূড়ান্ত রায়ে দণ্ড থেকে খালাস পেয়েছেন নিজামী, যার মধ্যে একটিতে ফাঁসি ও দু’টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ ছিল ট্রাইব্যুনালের রায়ে।