নুহাশপল্লী থেকে ফিরে: বাংলা সাহিত্যের নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। অবকাশ যাপন, নির্জনতা উপভোগ, সাহিত্য চর্চা ও সৃষ্টির জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি গড়ে তোলেন বিশাল এক আবাসভূমি। যার নাম দেন ‘নুহাশপল্লী’। বড় ছেলে নুহাশ আহমেদের নামের সঙ্গে মিল রেখে দেওয়া হয় এই নাম।
গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে ল্যাংড়া বাজার ও পিরুজালী এলাকায় নুহাশপল্লীর অবস্থান। এটি লেখক হুমায়ূনের পারিবারিক অবকাশ যাপন কেন্দ্র হিসেবেই পরিচিত।
১৯৯৭ সালে বাগানবাড়ি করার লক্ষ্যে তিনি সেখানে একযোগে ২২ বিঘা জমি কেনেন। পরে আরও কিছু কিনলে জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৫ বিঘা। বর্তমানে বাগানবাড়িসহ ৪০ বিঘা জমি রয়েছে।
ঢাকা শহরের ব্যস্ততায় লেখক যখন হাঁপিয়ে উঠতেন, তখন তিনি এ পল্লীতে ছুটে আসতেন। মাঝে মধ্যে পল্লীতে দেশ-বিদেশের বড় বড় লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পীদের নিয়ে গল্প-আড্ডা ও গানের আসর বসতো। এসবের মধ্যমণি হিসেবে থাকতেন আড্ডাপ্রিয় হুমায়ূন আহমেদ।
পাঠকের প্রিয় লেখক এখন নেই। রয়েছে তার স্মৃতিমাখা অসংখ্য বৃক্ষরাজির সবুজে সজ্জিত নুহাশপল্লী। এরপরও লেখকের সুপরিকল্পিতভাবে সাজানো পল্লীর প্রতি দেশের পাঠক ও ভ্রমণপিপাসুদের আগ্রহ-আকর্ষণের কমতি নেই।
সুনসান নীরবতা কিংবা নির্জনতা উপভোগ করার জন্য নুহাশপল্লীর জুড়ি মেলা ভার। তাই বাহারি পাখির কুজনে নির্জনতা উপভোগ করতে এখানে প্রায় সব বয়সী মানুষ ছুটে আসেন। প্রেমিক যুগলদের উপস্থিতিও লক্ষ্য করার মতো।
নুহাশপল্লীর গেট পার হতেই ডানপাশে চোখে পড়বে ধবধবে সাদা মা-সন্তানের চমৎকার এক ভাস্কর্য। পাশেই রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের ম্যুরাল। এটি কিছুদিন আগে লেখকের ৬৭তম জন্মদিনে উন্মোচন করা হয়েছে।
ম্যুরালের পাশে রয়েছে বিভিন্ন গাছপালায় ঢাকা একতলা বাড়ি। এই বাড়িতেই লেখক এসে থাকতেন। বাড়ির সামনের মাঠে মাটি কামড়িয়ে রয়েছে গাঢ় সবুজ ঘাস। তারপাশে দু’টি ছোট টং ঘর। রয়েছে দাবা ঘর। গোটা ঘরটাই দাবা খেলার বোর্ড ও গুটিতে সাজানো।
আরও একটু সামনে গেলে চোখে পড়বে টিন আর ইটের দেয়ালে নির্মিত বিশাল একটি ঘর, নাম তার ‘বৃষ্টিবিলাস’। বৃষ্টির সময় লেখক এই ঘরে থেকে টিনের চালে ঝুম বৃষ্টি উপভোগ করতেন।
পর্যায়ক্রমে ঘুরে ঘুরে চোখে পড়বে ভূতবিলাস, লীলাবতী দিঘি, লেক, লেকের ওপর সেতু, রাক্ষসের মূর্তি, ড্রাগন ও ডাইনোসরের ভাস্কর্য, পদ্মপুকুর, মৎস্যকন্যাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। যা হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন নাটক ও ছবিতে দেখা যায়।
রয়েছে নানা প্রজাতির বৃক্ষ ও অসংখ্য ঔষধি গাছ। ৪০ বিঘা জমিজুড়ে সাজানো এ ভূমি যেনো সৌন্দর্যের এক লীলাক্ষেত্র। ঘুরে ঘুরে যখন ক্লান্ত, দেড়শো টাকায় নুহাশপল্লীর ব্যবস্থাপনায় দুপুরের প্যাকেজ খাবার খেয়ে নিতে পারেন।
সবকিছু ঘুরে ফেরার পথে ছায়াশীতল লিচু তলায় না গেলে যেন অপূর্ণই থেকে যাবে। কারণ, এ গাছতলায় চিরনিন্দ্রায় শায়িত রয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। এখানে এসে অনেক ভক্ত, হুমায়ূন ও তার সৃষ্টিকর্মকে স্মরণ করে চোখের পানি আড়াল করেন।
বছরের আট মাস সাধারণ দর্শনার্থীরা জনপ্রতি ২শ টাকা দিয়ে নুহাশপল্লী ঘুরতে পারেন। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এটি খোলা থাকে। শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে দেড়শো টাকা দিয়ে ঢোকার সুযোগ রয়েছে।
শুধু যারা হুমায়ূনের কবর জিয়ারত করতে চান, তারা নুহাশপল্লীতে প্রবেশ না করেও একটি নির্দিষ্ট পথ দিয়ে ঢুকে এটি করতে পারেন। হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ১৩ নভেম্বর ও মৃত্যুদিন ১৯ জুলাই, এই দু’দিন নুহাশপল্লী সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।
ডিসেম্বর থেকে মার্চ, এ চার মাস বিভিন্ন কোম্পানি, করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও স্কুল-কলেজের পিকনিক বা শিক্ষা সফরের জন্য বরাদ্দ থাকে। তবে এজন্য আগে থেকে অনুমতি নিতে হয়। একদিনে একটির বেশি পিকনিক দলকে অনুমতি দেওয়া হয় না।
ছুটির দিনে ৬৯ হাজার টাকা ও ছুটির দিন ছাড়া ৫৭ হাজার ৫শ টাকা স্পট ফি দিয়ে নুহাশপল্লীতে পিকনিক বা বনভোজন উদযাপনের সুযোগ রয়েছে। স্কুল-কলেজের ক্ষেত্রে ছুটির দিনে ৫০ হাজার ও ছুটির দিন ছাড়া ৪০ হাজার টাকা স্পট ফি দিতে হয়। তবে ভ্যাট প্রযোজ্যের বিষয়টি এখানেও জড়িত।
বুকিং দিতে যোগাযোগ করতে হবে ০১৭২২-৪৩৭৮৮৩ ও ০১৭১২-০৬০৯৭১ নম্বরে।
এ থেকে অর্জিত আয় নুহাশপল্লীতে নিয়োজিত ১২ জন কর্মচারীর বেতন-ভাতা এবং নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদের প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ পরিচালনায় ব্যবহার করা হয়।
বলে রাখা ভালো, নুহাশপল্লীতে দর্শনার্থীদের রাতে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
নুহাশপল্লীর ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বুলবুল ও সহকারী ব্যবস্থাপক পাপন খান বলেন, স্যারের (হুমায়ূন) বিশেষ অনুমতি ছাড়া আগেও কেউ এখানে রাত্রিযাপন করতে পারেননি। এখন তো সেই সুযোগ আরও নেই।
যেতে হবে যেভাবে
জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে ২০ টাকা লেগুনা ভাড়ায় হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ড নামতে হবে। বাসস্ট্যান্ড থেকে নুহাশপল্লী আট কিলোমিটার দূরে। এখান থেকে লেগুনা, রিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় নুহাশপল্লী যাওয়া যায়। সরাসরি গেটে যেতে চাইলে ১শ ৫০ থেকে ১শ ৭০ টাকা অটোরিকাশা কিংবা রিকশা ভাড়া লাগবে।
এছাড়া, হোতাপাড়া থেকে লেগুনাতে ২০ টাকা দিয়ে ল্যাংড়া মার্কেট নেমে, সেখান থেকে অটোরিকশায় ১০ টাকা দিয়ে নুহাশপল্লীর গেটে নামা যায়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের যেকোনো স্থান থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ড নেমে সেখানে যেতে পারেন।