ঢাকা : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিকে ঘিরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের স্টাফদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা গত বছরের মতো এবারও ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও কার্যালয় তালাবদ্ধ করে দেয়ার আতঙ্কে ভুগছেন।
গত বছরের ৩ জানুয়ারি রাত সোয়া ১২টার দিকে বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢুকে তল্লাশি চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। এর পর কার্যালয়ের তৃতীয় তলা থেকে গভীর রাতে দলের দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব ‘অসুস্থ’ রুহুল কবির রিজভী আহমেদকে অ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে যায় তারা।
রিজভী হাসপাতালে কয়েকদিন পুলিশের নজরদারিতে ছিলেন। কিন্তু ৭ জানুয়ারি রাতের কোনো এক সময় ওই হাসপাতাল থেকে গোপনে সটকে পড়েন তিনি।
এরপর রাজধানীর বিভিন্ন বাসা থেকে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে দলের বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মসূচি ঘোষণা করছিলেন বিএনপির এই নেতা। এভাবে কিছুদিন চলার পর ৩০ জানুয়ারি দিবাগত রাত পৌনে তিনটার দিকে রাজধানীর বারিধারার একটি বাসা থেকে রিজভীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গ্রেপ্তার করে।
এর আগে ৩ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশানে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে ‘অসুস্থ’ রিজভীকে দেখতে নয়াপল্টনের কার্যালয়ে আসার পথে বাধা দেয় পুলিশ। কার্যালয়ের ফটকের সামনে একটি ট্রাক আড়াআড়িভাবে রেখে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। ১৫ মিনিট পর খালেদা জিয়া গুলশানে নিজের বাসায় যাওয়ার জন্য ব্যারিকেড সরাতে বললেও তা না সরানোয় কিছুক্ষণ গাড়িতে অপেক্ষার পর আবার কার্যালয়ে ফিরে যান। রাতে সেখানেই অবস্থান করেন তিনি। তখন থেকেই মূলত নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া।
এদিকে, রিজভীকে নিয়ে যাওয়ার পর কার্যালয়ে থাকা আটজনকে বের করে দিয়ে কার্যালয় তালাবদ্ধ করে দেয় পুলিশ। ওই দিনের পর থেকে বিএনপি নেতাকর্মীরা আর কার্যালয়ে যাননি। দীর্ঘ ৩ মাস বন্ধ থাকার পর অবশেষে ৪ এপ্রিল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের প্রধান ফটকের তালা খোলা হয়। এর মধ্য দিয়ে ৯১ দিন পর সচল হয় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দুজন স্টাফ বাংলামেইলকে বলেন, ‘গত বছর এইদিন (৩ জানুয়ারি) গভীর রাতে গোয়েন্দা পুলিশ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢুকে তল্লাশির নামে রুম ভেঙে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। অসুস্থ যুগ্ম মহাসচিব স্যারকে (রিজভী) জোর করে ধরে নিয়ে যায়। এর পর কার্যালয়ের স্টাফদের বের করে দিয়ে মেইন গেইট তালা মেরে দেয় পুলিশ।’
৫ জানুয়ারি ঘিরে বিএনপি এ বছরও সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে। কর্মসূচিকে ঘিরে তারা আতঙ্কের মধ্যে আছেন। পুলিশ কখন কার্যালয়ে প্রবেশ করে নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে যায়, কখন কার্যালয় ফের তালাবদ্ধ করে দেয়, এমন নানা শঙ্কাযুক্ত প্রশ্ন তাদের মনে উঁকি দিচ্ছে।
রোববার (৩ জানুয়ারি) বেলা ১১টার দিকে কার্যালয়ে যান রিজভী আহমেদ। এর পর একে একে অন্য নেতারাও সেখানে যান। মির্জা ফখরুল ইসলাম দুপুর ১২টার দিকে কার্যালয়ে ঢোকেন আর ১টার দিকে ত্যাগ করেন। এর পর বিকেল ৪টার দিকে ৫ জানুয়ারির সমাবেশের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন রিজভী।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন দলের সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি, আসাদুল করিম শাহীন, মহিলা দল সাধারণ সম্পাদক শিরীন সুলতানা প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলন শেষে বিকেল ৫টার দিকে রিজভীসহ বাকিরা কার্যালয় ত্যাগ করেন। এরপর শুধু স্টাফরাই কার্যালয়ে অবস্থান করেছেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস ঘোষণা করে বিএনপি। নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে গত বছরের ৫ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দেয় দলটি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের জন্য ডিএমপির কাছে অনুমতি চায় তারা। আওয়ামী লীগও একইদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের ঘোষণা দেয়। ফলে পুলিশ কাউকেই সমাবেশের অনুমতি দেয় না। বিকল্প হিসেবে নয়াপল্টনে পার্টি অফিসের সামনে সমাবেশ করতে চাইলে বিএনপিকে তারও অনুমতি দেয়া হয় না। এরপরেও যেকোনো মূল্যে নয়াপল্টনে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় দলটি।
বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট নেতাদের ওইদিন নয়াপল্টনের সমাবেশে যোগদানের প্রস্তুতি রাখার নির্দেশনাও দেয়া হয়। ৫ জানুয়ারি নয়াপল্টনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দুইবার চেষ্টা করেও পুলিশি বাধায় গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে বের হতে ব্যর্থ হন খালেদা। এর পর ওইদিন বিকেলে কার্যালয়ের ভেতর থেকেই দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেন তিনি। ৯২ দিন চলার পর কর্মসূচি শিথিল হয়ে যায়। তবে ওই অবরোধ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়নি।
এবারও ৫ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের ঘোষণা দিয়ে অনুমতি পেতে ডিএমপির কাছে আবেদন করেছে দলটি। সমাবেশে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রধান অতিথি থাকার কথা রয়েছে। এ ছাড়া ওইদিন সারা দেশের জেলা সদরগুলোতেও সমাবেশ করবে বিএনপি।
৫ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগও সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে অনুমতি দেয়নি। তবে সমাবেশের জন্য বিএনপি বিকল্প হিসেবে নয়াপল্টন (দলীয় কার্যালয়ের সামনে) চেয়ে রোববার ডিএমপি বরাবর আবেদন করেছে। এ ব্যাপারেও ডিএমপি এখনো কিছু জানায়নি।
বিএনপির একাধিক সূত্রমতে, সমাবেশের অনুমতি না পেলেও এবার হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কোনো কর্মসূচিতে যাবে না। কেননা, বিএনপি এখন সংগঠনকে গোছানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সেজন্য পৌর নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ করলেও কোনো কর্মসূচি দেয়নি দলটি। তা ছাড়া, চলতি মাসের শেষের দিকে দলের কাউন্সিল করতে চায় তারা।
দলটির হাইকমান্ড মনে করছে, ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে কঠোর কোনো কর্মসূচিতে গেলে সরকারও হার্ডলাইনে চলে যাবে। সেক্ষেত্রে তাদের নেতাকর্মীরা হামলা-মামলা-গ্রেপ্তারের শিকার হবে। ফলে নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারবে না, যা সংগঠনের জন্য বুমেরাং হবে। এতে করে সংগঠন গোছানোর কাজ আবারো পিছিয়ে যাবে।
সূত্র মতে, ৫ জানুয়ারি সমাবেশের অনুমতি না পেলে ঢাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারে বিএনপি। এ ছাড়া ওইদিন জেলা সদরগুলোতে পূর্বঘোষিত সমাবেশের কর্মসূচি বহাল থাকবে। তবে ঢাকায় বিক্ষোভের অনুমতি না পেলে পরবর্তীতে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অথবা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ইনডোর জনসভা করতে পারে। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্মসূচি পরিবর্তিত হতে পারে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বাংলামেইলকে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে বিএনপির সমাবেশ হবে। সোহরাওয়ার্দীর বিকল্প হিসেবে নয়াপল্টন চাওয়া হয়েছে। সুতরাং সমাবেশের ব্যাপারে আমরা এখনো আশাবাদী। আমরা আশা করতে চাই, সরকারের বোধোদয় হবে এবং তারা গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির মধ্যে ফিরে আসবেন। তবে যদি শেষ পর্যন্ত সমাবেশের অনুমতি না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে। দলের নেতারা বসে তা নির্ধারণ করবেন।’
কী ধরনের বিকল্প চিন্তা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সময়মতো তা আপনাদের (গণমাধ্যম) মাধ্যমে দেশবাসীকে অবহিত করা হবে। তবে সমাবেশের ব্যাপারে আমরা শেষ পর্যন্ত আশাবাদী থাকতে চাই।’