বুধবার রাত ২টা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মিরপুরবাসী। কনকনে শীতের মধ্যরাতে হঠাৎ সরু গলিতে ভারী অস্ত্রের ঝনঝনানি। চারপাশে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা দলের সদস্যরা তৎপর। ভোরের আলো ফোটার আগে হ্যান্ডমাইকে পুলিশের ঘোষণা, ‘জঙ্গিরা সারেন্ডার করো, নইলে রক্ষা নেই।’ দফায় দফায় ঘোষণার পরও কোনো সাড়াশব্দ নেই। অতঃপর শুরু হলো চূড়ান্ত অভিযান। ফজরের আজানের পরপরই সরিয়ে নেওয়া হয় ছয়তলা বাড়ির সব বাসিন্দাকে। পুলিশের বিশেষ ইউনিট সোয়াত, ডিবির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল ও পুলিশের চৌকস ৩৫ সদস্য পাঁচটি দলে বিভক্ত হয়ে শুরু করেন বিশেষ অভিযান। বাড়ির ছাদ, সিঁড়ি, গেট ও আশপাশের এলাকায় অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে
.প্রস্তুত সবাই। বিশেষ উপায়ে ভেঙে ফেলা হলো ছয়তলার ফ্ল্যাটের দরজা। পাল্টা প্রতিরোধে ভেতর থেকে জঙ্গিরাও হাতে তৈরি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। চুরমার ফ্ল্যাটের একাধিক কাচের জানালা। তবে শেষ পর্যন্ত ১৪ ঘণ্টার রক্তপাতহীন অভিযানে পরাজিত হয় জঙ্গিরা। বুধবার গভীর রাত থেকে শুরু হওয়া ‘অপারেশন মিরপুর’-এর সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় গতকাল বিকেল ৪টায়। দিনভর টেলিভিশনের পর্দায় রাজধানীর মিরপুরের শাহ আলীতে জেএমবির আস্তানা ঘিরে চাঞ্চল্যকর এ অভিযানের সরাসরি দৃশ্যও দেখেছে সারাদেশের লাখ লাখ মানুষ।
রাজধানীর শাহ আলী থানাধীন ৯ নম্বর রোডের ৩ নম্বর বাড়ির ছয়তলার একটি ফ্ল্যাটে এ অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দুই সদস্যসহ সন্দেহভাজন ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় একই এলাকা থেকে ওই গ্রুপের আরেক জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ওই ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয় হাতে তৈরি ১৬টি তাজা গ্রেনেড, বিপুল বিস্ফোরক, সুইসাইড ভেস্ট, তিনটি মোবাইল ফোনসেট ও কাগজপত্র। উদ্ধার করা দেশীয় গ্রেনেড ‘ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস’ নামে পরিচিত। ওই মেস থেকে উদ্ধার বিস্ফোরক কাপড়ে পেঁচানো ছিল। পরে পাশের একটি খোলা জায়গায় উদ্ধার করা গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করা হয়।
পুলিশের দাবি, উদ্ধার করা বিস্ফোরক দিয়ে ২০০ গ্রেনেড তৈরি করা সম্ভব ছিল। মিরপুরের ১৯টি গির্জা, শাহ আলী মাজারে একযোগে হামলার টার্গেট করে ওই ফ্ল্যাটে বোমা তৈরি করছিল জেএমবির সদস্যরা। এ ছাড়া বড়দিন ও থার্টিফার্স্ট নাইট ঘিরেও ছিল নাশকতার পরিকল্পনা। এর আগে হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি সমাবেশে বোমা হামলার পর উদ্ধার করা গ্রেনেড, কামরাঙ্গীরচর থেকে উদ্ধার গ্রেনেডের সঙ্গে গতকালের গ্রেনেডের সাদৃশ্য রয়েছে। তবে এখনও গ্রেফতার তিন জেএমবি সদস্যের নাম প্রকাশ করেনি পুলিশ। জানা গেছে, তাদের একজন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একই বাসা থেকে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার চারজন হলেন নাহিদ, কামাল, মামুন ও রেজা। এই ঘটনায় গতকাল রাত ১টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।
২০১০ সালের আগস্টে মিরপুরের দক্ষিণ বিশিল এলাকায় জেএমবির একটি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে এসএমজি, পিস্তল, গুলি, গান পাউডার, গ্রেনেড ও জিহাদি বই পাওয়া যায়। এর আগে মিরপুরের পাইকপাড়ায় জেএমবির আস্তানায় অভিযান চালাতে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়া হয়। ওই অভিযানে জেএমবির এক সদস্যের স্ত্রীর হাতের কব্জি উড়ে যায়। আহত হয় তার শিশুসন্তান।
যেভাবে অভিযান :শাহ আলী এলাকার ৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় ৩ নম্বর বাড়ি। গলির প্রস্থ সর্বোচ্চ ২৫ ফুট। প্রথমেই শেখ রাসেল শিশু উদ্যান। গলির শেষ দিকে টিনশেড খুপরিঘর। এমন পরিবেশে ৩ নম্বর বাড়ির ছয়তলায় জেএমবির আস্তানা। জেএমবির রসদের এই গোপন আস্তানার খবরটি পাওয়া যায় বগুড়া থেকে গ্রেফতার জেএমবি নেতা জান্নাতুল ফেরদৌসের কাছ থেকে। ওই আস্তানা সম্পর্কে একই ধরনের তথ্য দেন আরেক জেএমবির নেতা শাকিল। দু’জনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার প্রথমে শাহ আলী এলাকা থেকে জেএমবির এক সদস্যকে আটক করা হয়। পরে তাদের সবার দেওয়া তথ্যে বুধবার রাত ২টার দিকে শুরু হয় অভিযান। এই প্রথমবারের মতো অপারেশনের জন্য ডাক পড়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রশিক্ষিত বাহিনী ‘সোয়াত’। এর পর একে একে সেখানে আসেন ডিবির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলসহ মিরপুর বিভাগের পুলিশ সদস্যরা। মধ্যরাত থেকে আশপাশের পুরো এলাকা ঘিরে রাখা হয়। অভিযানের বিষয়টি টের পেয়েই ছয়তলার পেছনের ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে বাইরে বোমা ছোড়েন জেএমবির সদস্যরা। সেই বোমার স্পিল্গন্টার ও ভাঙা কাচ গিয়ে পড়ে ভবনের পাশের একতলা টিনশেড বাসার ওপর। জেএমবির সদস্যরা ছুড়ে নিচে ফেলেন মোবাইল ফোন সেট ও সিমকার্ড। সকাল ৭টার দিকে জেএমবির আস্তানায় ঢুকে প্রথমে দু’জনকে ও পরে পাশের ফ্ল্যাট থেকে আরও সন্দেহভাজন চারজনকে গ্রেফতার করা হয়।
অভিযানে সরাসরি অংশ নেওয়া ডিবির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান এডিসি ছানোয়ার হোসেন বলেন, বাসার ভেতরে বেশি আসবাব ছিল না। তারা মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমাতেন। ট্রাঙ্কের ভেতর ও বাজারের ব্যাগে রাখা হাতে তৈরি বোমা পাওয়া গেছে।
অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা :৩ নম্বর বাড়ির পেছনের দিকের দেয়াল ঘেঁষেই একতলা টিনশেড বাসায় দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন মাহফুজা বেগম। গতকাল তার অন্য রকম এক ভোরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘুম ভেঙেছে। মাহফুজা বলেন, ভোরে তার দুই সন্তান সোহান ও জোহান ঘুমাচ্ছিল। সবেমাত্র তার ঘুম ভেঙেছে। হঠাৎ টিনের চালে বিকট শব্দ। বাইরে বেরিয়ে দেখেন, বড় বড় কাচের টুকরো চালের ওপর ভেঙে পড়েছে। পাশের ছয়তলার বাড়ির ছাদের দিকে অনেক ধোঁয়া। ছয়তলার জানালার গ্গ্নাস ভাঙা। লোহার শিক বেঁকে গেছে। এর পর আশপাশের লোকজন ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করেন। শাহ আলী এলাকার ৯ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী আবদুল আজিজ জানান, ফজরের আজানের পরপর ঘুম ভাঙে। পাশের রোডে নিজের বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হন। এ সময় হঠাৎ রাস্তায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশের লোকজন দেখেন। এর পর থেকে অল্প সময় পরপর বিকট শব্দ পান।
জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে টালবাহানা করেন সন্দেহভাজন জঙ্গিরা : বাড়ির মালিক আবুল হোসেন ভুঁইয়া পেশায় ব্যবসায়ী। তার ছেলে সারোয়ার হোসেন ভুঁইয়া অপু বলেন, ছয়তলা বাড়ির ষষ্ঠতলায় দুই রুমের একটি ইউনিট তিন মাস আগে তারা ৯ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। নজরুল নামের একজন ভাড়া নিয়েছিলেন। তিনি চাকরি করেন বলে জানিয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে তিনজনকে ভাড়া দেওয়া হলেও বাসায় চারজন থাকবে বলে পরে জানানো হয়। তাদের মধ্যে একজন ছাত্র ও দু’জন চাকরিজীবী। আরেকজন গ্রামের বাড়ির এলাকা থেকে আসা তাদের ছোট ভাই।
সারোয়ার বলেন, বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি চাইলেও তারা দেননি। পরিচয়পত্র এখনও তৈরি হয়নি বা গ্রামের বাড়ি থেকে আনা হয়নি_ এমন কিছু বলেছিলেন। গ্রামের বাড়ির এলাকার নাম বলেছিলেন। তবে সেটাও স্মরণ করতে পারেননি তিনি। এর আগে বাসায় বাসায় পুলিশের সরবরাহ করা তথ্য-ফরমে তারা ভুল তথ্য দিয়েছিল কি-না সেটা যাচাই করা হচ্ছে।
জব্দ করা উপাদান দিয়ে ২০০ গ্রেনেড তৈরি করা যেত :বিকেল ৪টার দিকে অভিযান শেষে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল, সোয়াত, ডিবির অন্যান্য দল ও পোশাকে থাকা পুলিশ সদস্যরা এ অভিযান চালিয়েছেন। এখান থেকে ১৬টি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড ও দুটি বোমা জব্দ করে নিষ্ক্রিয় করা হয়। এখান থেকে জব্দ করা উপাদান দিয়ে অন্তত ২০০ গ্রেনেড তৈরি করা সম্ভব ছিল বলেও জানান ডিবির এই কর্মকর্তা।
পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করুন :স্থানীয় এমপি আসলামুল হক দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনাটি সবার জন্য একটি বড় শিক্ষা যে, ঠিকঠাক খোঁজ না নিয়ে বাড়ি ভাড়া দিলে কত বড় সমস্যা হতে পারে। তিনি পুলিশের দেওয়া তথ্য-ফরম পূরণ করে জমা দেওয়ার জন্য সবাইকে পরামর্শ দেন।
সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা হিসেবে চিহ্নিত বাড়িটির মালিক আবুল হোসেন ভুঁইয়া সরকারদলীয় নেতা_ এক সাংবাদিকের এমন তথ্য প্রসঙ্গে এমপি বলেন, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি এখানে দেখার বিষয় নয়। জঙ্গি কার্যক্রমে যে জড়িত থাকবে, তার বিচার হবে।