ঢাকা: মাত্র ১০০ টাকা খরচ করলেই পাওয়া যাচ্ছে সংসদ সদস্য। চাইলে সংসদ সচিবালয়ও কেনা যাবে এ টাকায়। বাড়তি হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে ভিভিআইপি ও ভিআইপি মর্যাদা। সঙ্গে আছে হাজার হাজার টাকার সুবিধা। এছাড়াও আছে নিরাপত্তা রক্ষায় কর্তব্যরতদের লম্বা স্যালুট। খোদ সংসদ সচিবালয় থেকে বিক্রি হচ্ছে এসব। আর এসবই পাওয়া যাচ্ছে সচিবালয়ের এক ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী মৃণাল কান্তি মণ্ডলের কাছে। মন্ত্রী, এমপির পিএস, এপিএসরা ধর্না দেন তার কাছে। সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও রয়েছেন ওই তালিকায়। সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদ সচিবালয় স্টিকার কিনলেই মিলছে এমন সব সুবিধা। নিয়ম অনুযায়ী একজন এমপি তার গাড়িতে সংসদ সদস্যর একটি স্টিকার ব্যবহার করতে পারবেন। অপরদিকে সংসদ সচিবালয়ের পরিবহন পুলের গাড়িতে থাকবে সচিবালয়ের স্টিকার। এসব নিয়ম কেবল কাগজ-কলমেই শোভা পাচ্ছে। হিসাব অনুযায়ী ৩৫০ জন সংসদ সদস্য, সংসদ পরিবহন পুলের ৬৩টি ও পরিবহন পুলের প্রায় ১০০টি গাড়ির জন্য থাকবে ৫১৩টি স্টিকার। সেখানে শুধু রাজধানীতেই রয়েছে প্রায় ৬০০০ স্টিকারসহ গাড়ি। চলতি সংসদের এমপিদের পাশাপাশি অনেক সাবেক এমপিও এসব স্টিকার ব্যবহার করছেন। পাচ্ছেন নানা ধরনের সুবিধা। শুধু তাই নয় এমপিদের ব্যক্তিগত সহকারী, দলীয় নেতা-কর্মী ও আত্মীয়স্বজনের গাড়িতেও ব্যবহার হচ্ছে সংসদ সদস্য অথবা জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের স্টিকার। এমনকি ভাড়ায় খাটানো গাড়িতেও স্টিকার লাগিয়ে আদায় করা হচ্ছে সুবিধা। গাড়িতে এসব স্টিকার ব্যবহার করে ঘটানো হচ্ছে নানা ধরনের অপরাধ। অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান হচ্ছে হরহামেশা।
যেভাবে মিলছে স্টিকার
এক সংসদ সদস্যের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হয় সংসদ সচিবালয়ের ডাটা এন্ট্রি কন্ট্রোল সুপারভাইজার মৃণাল কান্তি মণ্ডলের কাছে। চারটি সংসদ সদস্যের স্টিকার চাইলে তিনি বলেন, কোন অসুবিধা নেই। আপনার যে কয়টি লাগবে নিয়ে যান। প্রতিটির দাম পড়বে ১০০ টাকা। এরপরই তার কাছ থেকে ২০০ টাকায় দু’টি স্টিকার কেনা হয়। জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের স্টিকারও লাগলে নিতে পারেন বলে জানান ওই কর্মচারি। অফিসে তাকে না পেলে মোহাম্মদপুরের বাসায় গেলেও এসব পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংসদ সচিবালয়ে চাকরি করার আগে মৃণাল কান্তি নিউ মার্কেটের একটি প্রেসে কাজ করতেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্পিকার থাকার সময় সংসদ সচিবালয়ে পোস্টার, ডায়েরি ও ক্যালেন্ডার ছাপানোর কাজে ঠিকাদারি শুরু করেন। এক পর্যায়ে ফটোকপি মেশিন অপারেটর হিসেবে চাকরি নেন সংসদ সচিবালয়ে। এ পর্যন্ত তিনটি পদোন্নতি পেয়ে বর্তমান পদে দায়িত্ব পালন করছেন। সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে, তাকে পদোন্নতি দিতে নিয়োগ বিধিমালা পর্যন্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। তার এসব ব্যবসা থেকে সুবিধা পান সংসদ সচিবালয়ের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এদের মধ্যে অতিরিক্ত সচিব প্রণব চক্রবর্তী একজন। তার নির্দেশেই মৃণালকে মুদ্রণ শাখায় বদলি করা হয়।
স্টিকার দিয়ে যা হচ্ছে
সংসদ সদস্যের স্টিকার ব্যবহার করে ঘটানো হচ্ছে নানা ধরনের অপরাধ। এমপিদের পাশাপাশি এসব স্টিকার এখন ছড়িয়ে পড়েছে অপরাধীদের হাতেও। বিশেষ করে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের মতো গুরুতর অপরাধে ব্যবহার হচ্ছে এসব। এছাড়া রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে এসব স্টিকার ব্যবহার হচ্ছে বিশেষ সুবিধা আদায়ে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সংসদ সদস্য স্টিকার রয়েছে এমন গাড়ি দেখলেই পুলিশ সমীহ করে। এ সুযোগে বেশির ভাগ গাড়ি ট্রাফিক আইন অমান্য করে। অনেক সময় উল্টো পথ ধরে গাড়ি চালানো হয়। এছাড়া সেতু ও ফেরি ব্যবহারে টোল দেয়া হয় না। সচিবালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্পর্শকাতর এলাকায় এসব গাড়ি অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে পার্কিংয়ের বিশেষ সুবিধাও আদায় করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংসদ সচিবালয়ের অনেক কর্মকর্তাও বিশেষ সুবিধা আদায়ে তাদের গাড়িতে ব্যবহার করছেন এসব স্টিকার। আইন শাখার এক কর্মকর্তার গাড়িতে রয়েছে এ স্টিকার। এছাড়া আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হকের পিএস এম মাসুম স্টিকার ব্যবহার করেছেন তার রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়। তখন তিনি সংসদ সচিবালয়ের কমিটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংসদের ডেপুটি সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস সাদরুল আহমেদ বলেন, বিষয়টি উদ্বেগজনক। সম্প্রতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে আমাদের কাছে সংসদ সদস্য ও সংসদ সচিবালয়ের স্টিকারের নমুনা চাওয়া হয়। ভুয়া স্টিকার ব্যবহারের বিষয়টি তাদেরও নজরে এসেছে। পরে আমাদের পক্ষ থেকে স্টিকারের নমুনা পাঠানো হয়।
স্টিকার বিক্রি প্রসঙ্গে মৃণাল কান্তি মণ্ডল মানবজমিনকে বলেন, মন্ত্রী এমপিদের পিএসরা চায় তাই বিক্রি করি। কালার প্রিন্ট করতে খরচ হয় ৯০ টাকা। আমার লাভ থাকে মাত্র ১০ টাকা। তিনি বলেন মন্ত্রীর পিএস, আইন শাখার কর্মকর্তা, এমনকি সার্জেন্ট এ্যাট আর্মসও আমার কাছ থেকে স্টিকার নিয়েছেন। তবে আজ থেকে এ ধরনের স্টিকার আর কখনও বিক্রি করবো না। বাসা ও অফিসে যে কয়টি স্টিকার আছে সবগুলো ছিঁড়ে ফেলবো। প্রসঙ্গে স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী গতকাল মানবজমিনকে বলেন, এটা গুরুতর অপরাধ। সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে। প্রতিবেদকের উপস্থিতিতেই তিনি সংসদ সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিজ দপ্তরে ডেকে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। (মানবজমিন)