ঢাকা: ‘বায়োস্কোপ’ বাংলার হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্যের নাম। আর মুক্তিযুদ্ধ হারাতে বসা অন্য এক চেতনার নাম। এই দুই বিষয়কে রিলেট করে বানানো সিনেমা ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’। এই গল্প মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী প্রজন্মের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধেরই সিনেমা এটা। কারণ মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ছবির আবর্তন বিবর্তন। যুদ্ধের ছবি বলতে আমরা শুধু ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের বিরদ্ধে যুদ্ধটাই বুঝি। কিন্তু বাপজানের বায়োস্কোপের বিস্তৃতি চলতি সময় পর্যন্ত। যুদ্ধোত্তর সময়ে সমাজে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রভাব, এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির যে তাড়না। যে হাহাকার। যে লজ্জা। তা থেকে উত্তরণ, এবং সেখানে প্রধান নিয়ামক এক ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’।
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির একেবারে নিজস্ব আবেগের সাথে জড়িয়ে আছে। সেসময় পাক হানাদার ও তাদের দোসররা ছিল আতঙ্কস্বরূপ। এদের জন্যই লাখ লাখ বাঙ্গালিকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তাই দেশ স্বাধীন হলে রাজাকাররা হয়ে উঠে আপামর বাঙালির কাছে এক ঘৃণ্য। শুধু তারাই নয়, তাদের পরবর্তী বংশধরেরাও পূর্বপুরুষের অপরাধকে সমর্থন দিয়ে নিজেরাও চরম ঘৃণ্যজীবে পরিনত হয়েছে। যতো প্রভাবশালীই তারা হোক না কেন, তাদেরকে এদেশের মানুষ ঘৃণাই করেন। ছবিতে জীবন সরকারের চরিত্রটি রাজাকারের পরবর্তী বংশধরের প্রতিনিধি। যার মামা কিনা ছিল ৭১-এ রাজাকারদের লিডার। রাজাকার মামার বদৌলতেই একটি চরের মালিকানা পান জীবন সরকার। চরটি ভাগিনাকে দান করেছেন বলে চরের নামও ‘চর ভাগিনা’! এবং এটা যমুনার পাড়ে।
একজন পুলিশ চায় তার ছেলেও পুলিশ হোক, মাস্টার তার ছেলেকে মাস্টার হিসেবে গড়তে চায়, ইঞ্জিনিয়ারও তার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেই পেতে চায়; সেরকভাবে একজন ছেলেও তার বাবার মতোই হতে চাইবে, চায়ও। অবচেতনভাবে হলেও চায়। হিউম্যান ন্যাচার বলে যে একটা বিষয় আছে, এটা বোধয় কিছুটা এরকমই। ভিন্নকিছুও হতে পারে! এই যে বাবার মত হতে চাওয়ার যে বিষয়টা। হোক অবচেতনভাবে এটা ‘চর ভাগিনা’ অঞ্চলের কৃষক হাসেন মোল্লার মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবল হলে মৃত বাবার বায়োস্কোপ নিয়েই সে বেড়িয়ে পড়ে, কৃষিকাজ ছেড়েছুড়েই। দ্বিধা ছিল এই সময়ে এসেও বায়োস্কোপ লোকে দেখবে কিনা! আর সেজন্যই বায়োস্কোপের ছবির বিষয়বস্তু দিল্লী, মক্কা, মদিনা কিংবা আগ্রার তাজমহল না হয়ে বাংলার মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাসকে চমৎকার বর্ণনার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেন।
পুঁথির মাধ্যমে বায়োস্কোপ নিয়ে গ্রামে ঘুরে ঘুরে ১৯৭১ সালে জীবন সরকারের মামা রাজাকার ইউসুফের হাতে নিহত তার বীরমুক্তিযোদ্ধা চাচার নির্মম অত্যাচারিত হয়ে মৃত্যুর গল্প বলে বেড়ান। কান খাড়া হয়ে উঠে যমুনার পাড়ে চরের মালিক জীবন সরকারের। অস্তিত্বে টান লাগে তার। তাই হাসেনকে বায়োস্কোপ দেখাতে নানাভাবে নিষেধ করেন। বাধা দেন। কোনোবারই হাসেনকে বায়োস্কোপ দেখানো থেকে দমাতে পারেন না। হাসেনের চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জীবন সরকার গালি দেয় ‘বান্দির বাচ্চা’ বলে, এই বিষয়টি হাসেনকে বায়োস্কোপ ফেরি করতে আরো উস্কে দেয়। হাসেনের মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধ করে যারা দেশটাকে স্বাধীন করলো তারা আজ হয়ে গেল ‘বান্দির বাচ্চা’?
এই বোধ তাকে আরো বেশী পীড়া দেয়, বায়োস্কোপ দেখানোর বিষয়ে সিদ্ধান্তে আরো অটল থাকে হাসেন।
পুরো সিনেমাটা এইরকম প্রতীকময়। এতো সিম্বলিক বাংলা সিনেমা সাম্প্রতিক সময়ে খুব একটা নির্মাণ হয়নি এই তল্লাটে। এখানে বায়োস্কোপটাই মূলত একটা প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। আর তাই যতোবারই বাধা আসে হাসেন বলে উঠেন ‘বায়োস্কোপ চলবে’। বায়োস্কোপ দেখানোকে ঘিরে নানা ধরণের সংকট আসে ‘চর ভাগিনা’ অঞ্চলের মানুষের উপর। এখানে জীবন সরকার কর্তৃক লবনের সংকট বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামান্য লবন সংকটে ‘চর ভাগিনা’-এর মানুষের হাহাকারকে হাস্যকর মনে হলেও এটাকে যদি রুপক হিসেবে দেখে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রভাব আর প্রতিপত্তি আর হুঙ্কারের কথা চিন্তা করেন তাহলে এমনিতেই উত্তর পেয়ে যাবেন। ছবিতে জীবন সরকারের কৃত্রিম লবন সংকটকে অসাধারণ মনে হয়েছে।
বাপজানের বায়োস্কোপ মুক্তির কথা বলে, স্বাধীনতার কথা বলে, সত্যের কথা বলে; বাপজানের বায়োস্কোপ মূলত ইতিহাসের ফেরি করে বেড়ায়। যে ইতিহাস নির্ভেজাল সত্য, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাস। বাংলা চলচ্চিত্রে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নিয়ে এমন প্রভাবশালী গল্পের চলচ্চিত্রায়ন অপ্রতুল। যে সিনেমায় শুধু মুক্তিযুদ্ধে ঘটমান কোনো রোমহর্ষক নারকীয় কাহিনীর আবেগমথিত আর নাটকীয় পরিবেশনায় নয়, বরং যাপিত জীবনে কিছু প্রশ্নও রেখেছেন?
সেইসাথে গণজাগরণের পথটিরও কি ইঙ্গিত দেয়নি ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’?
ছবিতে ‘স্ল্যাং’ মানে গাল মন্দ ব্যাপারটাও যে কখনো কখনো আপনাকে প্রবোধ আনন্দ দিতে পারে। এতটা তৃপ্তিদায়ক হয়ে উঠতে পারে ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’-এ এই ব্যাপারটাও লক্ষ করা গেল। যখন ছবির শেষ সময়ে জীবন সরকারকে তারই বডিগার্ড ‘নটিরপুত আর কুত্তা বিলাইয়ের বাচ্চা’ বলে লাঠি নিয়ে তাড়া করে তখন! অন্তত অসাধারণভাবে ‘নটিরপুত’ গালির ব্যবহারে দক্ষতার জন্যই যে কারো ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’ দেখা উচিত বলেই মনে হয়!
এমনকি সিনেমা হলের দর্শকদেরও এই দৃশ্যের সময় দেখেছি চোয়াল শক্ত করে বিড় বিড় করতে, কেউ কেউতো চিৎকার দিয়েই উঠলো ‘ধর শালারে’ বলে। যদিও এরজন্যে চরিত্রাভিনেতারাই প্রশংসার দাবী রাখেন। বিশেষ করে জীবন সরকার চরিত্রের মধ্য দিয়ে শহীদুজ্জামান সেলিম এবং হাসেন চরিত্রে শতাব্দী ওয়াদুদ তাদের আগের অভিনয় দক্ষতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। শুধু মূল চরিত্র দুটোই নয়, বরং প্রতিটি ছোটো খাটো চরিত্রই আসলে নিজের সেরাটা দিয়েছেন ছবিতে। জীবন সরকারের নয়া বিবি, হাসেনের স্ত্রী, মাদ্রাসার ছাত্রটি যে রসগোল্লার বিনিময়ে বায়োস্কোপের জন্য ছবি এঁকে দিল, কিংবা বায়োস্কোপ দেখতে আসা করুণ মুখের এক অশিতীপর বৃদ্ধ, যার একটা চাহনিই আসলে মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে সিনেমা দেখতে আসা দর্শকদের দেখিয়ে দিল। এমন ন্যাচারালভাবে চরিত্রগুলোর বিস্তারের ফলেই আসলে একটা ভালো ছবি তৈরি হয়।
মাদ্রাসা’র ছাত্র ব্যাপারটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেনসেটিভ একটা বিষয়। সবকিছুতেই এদের এড়িয়ে যাওয়ার প্রবনতা আমাদের মাঝে ব্যাপক। স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ হিসেবে ঢালাওভাবে মাদ্রাসার ছাত্রদের আমরা দাঁড় করিয়ে দেই। একমাত্র মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে কাজ করতে বাংলাদেশে তারেক মাসুদকেই দেখেছি। ‘মাটির ময়না’ থেকে ‘রানওয়ে’, দুই ছবিতেই তিনি মাদ্রাসার ছাত্রদের দেখিয়েছেন খুব অসাধারভাবে। তাদেরকে কিভাবে কুক্ষিগত করে রাখা হয়, ধর্মীয় যাঁতাকলের আবরণে কিভাবে দমিয়ে রাখা হয় তাদের সত্যিকারের প্রতিভাকে, তাদের সৃষ্টিশীলতাকে। আর এই সুযোগে অন্য একটা মহল উস্কে দেয় ধর্মান্ধতার দিকে। অথচ তাদের মধ্যে কেউ কেউ যে সৃষ্টিশীল কাজের ক্ষমতা নিয়ে জন্মান এইটা ভোলেও কেউ কল্পনাই করি না।
‘বাপজানের বায়োস্কোপ’-এর অন্যতম একটা চরিত্র কিন্তু মাদ্রাসার ছাত্র। যার কিনা ছবি আঁকার অভ্যেস। মাদ্রাসার শিক্ষকদের ভয়ে সুযোগ পেলেই লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরে বসে সে ছবি আঁকে। বায়োস্কোপটি দীর্ঘদিন পর যখন নতুন করে চালু করলেন হাসেন, তখন মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী বর্ণনার সাথে সাথে ভেতরে যে ছবিগুলো দেয়া হয় সেগুলো তারই আঁকা।
মাদ্রাসার ছাত্রদের নেতিবাচকভাবেই বেশীরভাগ সময় সবাই উপস্থাপন করেন, এই বিষয়টা হয়তো মাদ্রাসার ছাত্রদেরও এক ধরণের ইনফিরিওরিটিতে রাখে। ফলত সমাজে যখন নিজের অবস্থান নিয়ে সে হীনমন্মতায় ভোগে, কেউ কেউ তাদের দিকে নাক উঁচু করে তাকান, তখন হয়তো তাকে আরো ভয়ঙ্কররূপে দূরেই ঠেলে দেয়া হয়। নির্মাতা রিজু তাদের অন্তত ভাবনার জায়গাটায় একটু স্পেস দিলেন। এই ছবিটা যদি কোনো মাদ্রাসার ছাত্র দেখেন, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় তিনি যতোই স্বাধীনতা নিয়ে ভিন্ন ধারণা পোষণ করুক না কেনো তার মধ্যে একটু হলেও বোধ তৈরি করবে, অন্তত সেই ভাবনার জায়গাটা তৈরি করে দিয়েছেন রিজু।
অন্তত ঢালাওভাবে মাদ্রাসা পড়ুয়া ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’ দেখতে আসা ছেলেটি যতোই নির্মম হোন না কেনো তার চোখের কোনে মেঘ জমবেই!
একটা সিনেমা দেখলে সেটা নিয়ে কিছু বলতে হয়, অন্তত নিজেদের মধ্যে ছবিটি নিয়ে আলোচনা করার একটা বিষয় থাকে। অন্তত আমরা যারা সিনেমা হলে যেয়ে সিনেমা দেখি, মানে সিনেমা হলে যেয়ে কালে ভদ্রে যখন ফেস্টিভাল মুখর পরিবেশে কোনো একটা বাংলা ছবি দেখার সুযোগ হয় তখন আমাদের ভালো লাগে, এবং হল থেকে বের হতে হতে আমরা নিজেদের মতো করে সেই সিনেমার মূল্যায়ন করি। কারো ভালো লাগে ছবির গল্প, কারো গান, কারো বা খারাপ লাগে ছবির এডিটিং, কারো কাছে দৃষ্টিকটু ঠেকে ছবিতে ভিএফএক্স-এর ভুল ব্যবহার, কিংবা কারো কারো কাছে অসাধারণ ঠেকে ছবির চরিত্রাভিনেতাদের দাপুটে অভিনয়। একটা ছবি দেখলে এইরকম মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকে বরাবরই, এবং এটাই স্বাভাবিক।
‘বাপজানের বায়োস্কোপ’ তেমনি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার বাইরের কোনো ছবি না। কিন্তু এই ছবি যে শক্তিশালী ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে সেটা এই ছবির গল্প। চিত্রনাট্যকার মাসুম রেজাকে প্রণতি এমন অসাধারণ এবং মৌলিক একটি গল্প বাংলার মানুষকে দেখানোর জন্য। যদিও এর জন্যে নির্মাতা রিয়াজুল রিজুই বাহবা বেশী পাওয়ার দাবী রাখেন। কারণ এরকম মৌলিক গল্প নিয়ে কোনো নির্মাতাতো ছবি করতে ভরসাই পান না আজকাল, তিনি সেই সাহসটা দেখালেন। ছবিটি এরইমধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে ৪২টি সিনেমা হলে চলছে, কিন্তু এই ছবি বাংলার প্রতিটি জীবিত সিনেমা হলে চলা উচিত। বাংলার প্রতিটি মানুষের দ্বারে নিয়ে যাওয়া উচিত।
স্বাধীনতার এই বায়োস্কোপ’কে কেউই দাবায়া রাখতে পারবে না। এই বায়োস্কোপ চলবে বিশ্বময়। জয় হোক শক্তিশালী বায়োস্কোপের!