ফেনী: ‘আপনার ভোট আমি দেব, যত খুশি তত দেব’ এটি হচ্ছে ফেনীর ভোটের প্রবাদ। ফেনীতে ভোট মানে রুপকথার গল্প। বর্তমান সরকার প্রথম বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ফেনীতে ভোটের রেওয়াজ হারিয়ে গেছে। ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে পারেনি দীর্ঘদিন। তবে ব্যালট পেপারে ঠিকই সিল পড়ছে। সরকার দলীয় ক্যাডাররা ভোটের আগের দিন রাতে আর নয় ভোট শুরু হওয়ার আগে বাক্সভর্তি করেছে। এই হচ্ছে বিগত সাত বছরের ভোটের নমুনা।’ এভাবে কথাগুলো জানালেন ফেনী শহরের বাসিন্দা আমীরন হোসেন, রুহুল আমীন ও নুরুল ইসলাম।
বর্তমান আওয়ামী শাসনামলে দু’দফা উপজেলা চেয়ারম্যান ভোট, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এসব ভোটে ফেনীর ভোটারদের শতকরা ৯৫ ভাগ প্রকৃত ভোটার ভোট দিতে পারেনি। এবার খোদ দু’টি পৌরসভায় ভোট আসার আগেই নির্বাচিত হয়ে গেছেন প্রার্থীরা।
সারাদেশে প্রথম দফা পৌরসভা নির্বাচন শুরু হলেও ফেনীর ৩টি পৌরসভায় নির্বাচনী আমেজ নেই। ১৪ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ হলেও রির্টানিং অফিসারের কার্যালয়ে যায়নি কোনো প্রার্থী। অবশ্যই ফেনীর এই তিনটি পৌরসভায় মেয়র, সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের ৫১টি পদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত দুই মেয়রসহ ৪৬ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিয়তায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন অনেক আগে।
বাকী ৫টি পদের জন্য নির্বাচন হলেও প্রার্থীরা ছুটছে না ভোটারদের কাছে। তারা ছুটছে ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম হাজারীর কাছে। যেকটি ওয়ার্ডে নির্বাচন হচ্ছে সেসব ওয়ার্ডের ভোটাররা জানিয়েছেন, প্রার্থীরা এখন আর ভোট চায় না, নিজাম হাজারীর দোয়া চায়।
গত ১৫ ডিসেম্বর দুপুর ১টায় ফেনী পৌরসভার ১৪ নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মনির হোসেনের নির্বাচনী মতামত জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন এমপি সাহেবের কাছে আসছি, আপনারা এলাকায় গেলে আমি যাবো।’
ফেনী পৌরসভার ১৪ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবুল হাশেম, মফিজুর রহমান, ছিদ্দিক আহম্মদ জানান, কোনো প্রার্থীকে ভোট চাইতে দেখিনি। ভোট চেয়ে লাভ কী? এখন মেয়র-কাউন্সিলর হতে লাগে এক ভোট। তবে এদের কেউ এক ভোট দেয়ার সে ক্ষমতাধর ব্যক্তির নাম ধরেননি।
তবে অপর একজন নাম গোপন রাখার শর্তে এই প্রতিবেদককে জানান, সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তি নিজাম হাজারী। জয়নাল হাজারীর জমানা যখন ছিল, তখন জয়নাল হাজারী বলেছিল আমি করবো আওয়ামী লীগ আর তোরা করবি হাজারী লীগ। জয়নাল হাজারী নেই ঠিকই, এখন সে হাজারী লীগই চলছে। ভেতরে জিনিস ঠিক আছে, তবে খোলস পাল্টেছে।
সরেজমিন ও রির্টানিং কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পৌর নির্বাচনে ফেনীর ৩ পৌরসভায় দেখা নেই নির্বাচনী আমেজসহ প্রচার প্রচারণা। ফেনী পৌরসভায় মেয়র পদে বিজয়ী হয়েছেন বর্তমান মেয়র ও আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থী হাজী আলাউদ্দিন। এ পৌরসভায় ১৮টি কাউন্সিলরের মধ্যে ১টি ছাড়া সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদের ৬টির সবগুলোতে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন সরকার দলীয় একক প্রার্থীরা।
এছাড়া পরশুরাম পৌরসভায় এক মেয়রসহ ৯ কাউন্সিলর ও ৩ সংরক্ষিত নারী কাউন্সিল পদে সরকারদলীয় একক প্রার্থী থাকায় সকলকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে রির্টানিং কর্মকর্তা।
এ পৌরসভায় মেয়র হয়েছেন বর্তমান মেয়র ও আওয়ামী লীগ মনোনিত নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী সাজেল। আর দাগনভূঞা পৌরসভায় ৯টি কাউন্সিলরের মধ্যে ৬টিতে ও ৩টি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে কাউন্সিল পদে সরকার দলীয় একক প্রার্থী হিসেবে সকলকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে রির্টানিং কর্মকর্তা। এ পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগ মনোনিত মেয়র প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র ওমর ফারুক এবং বিএনপি মনোনিত মেয়র প্রার্থী কাজী সাইফুর রহমান স্বপন নির্বাচনী মাঠে লড়াই করছে। তবে এককভাবে নির্বাচিত হওয়ায় আওয়ামী লীগের এই নেতারা মনে করেন সরকারের উন্নয়নের জোয়ারে নিশ্চিত পরাজিত হবে জেনে আর কোনো প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেননি।
এদিকে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নির্বিঘ্নে প্রচারণা চালালেও বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। খোদ দাগনভূঞা পৌরসভার মেয়রপ্রার্থী কাজী সাইফুর রহমান স্বপন ও ফেনী পৌরসভার ১৪নং ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী এম নুরুল ইসলামের ঘরে তালা ঝুলছে। তার বোন সাজেদা আক্তার জানান, প্রতিদিন বহিরাগত লোকেরা ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়ার হুমকি-ধামকি দেয়। জানালা দিয়ে ঘরের বিছানার মধ্যে পানি ঢেলে দেয়, ভাঙচুর করে। ভয়ে তাদের পরিবারের কেউ থাকে না।
উল্লেখ্য, মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেনি তিন পৌরসভার ৩৩ জন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী। যারফলে একক আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। তিনটি পৌরসভায় ১ লাখ ১৯ হাজার ৫শ ২ জন ভোটারের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতিয়াংশ ভোটার নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।