বিশেষ নিবন্ধ: রাষ্ট্রপতি, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী ও চুমকি আপাকে শিশু মামুনের লাল সালাম

Slider গ্রাম বাংলা জাতীয় টপ নিউজ নারী ও শিশু বাংলার মুখোমুখি বাধ ভাঙ্গা মত লাইফস্টাইল শিক্ষা সম্পাদকীয়

 

mamon

 

 

 

 

 

 

 

 

 

স্কুলের পোষাক পড়ে শিশুরা যখন স্কুলের আঙিনায় দৌঁড়ঝাপ করে খেলা করে হৈ হুল্লুরে মেতে থাকে তখন দশ বছরের শিশু মামুন হাতে ও কাঁধে চা মুড়ির( আঞ্চলিক ভাষায় ফুট খই বা পাপন)  ব্যাগ নিয়ে ফেরিওয়ালার কাজ করে। স্কুলের আঙিনায় বাবা মায়েরা মামুনের নিকট থেকে মুড়ির প্যাকেট নিয়ে প্রিয় সন্তানদের হাতে তুলে দেয় আর শিশুরা পাপন খেতে খেতে হৈ হুল্লুর করে স্কুল আঙিনাকে সরব করে তোলে। নতুন প্যান্ট জামা ও সুন্দর শাড়ি পড়ে বাবা মায়েরা যখন মামুনকে প্রিয় সন্তানদের অতিরিক্ত খাবারের টাকা দেয় তখন মামুনের বাবা মা ওই সব শিশুদের বাসায় ঝি বা বয়ের কাজ করেন।  এটা নিত্য দিনের চিত্র। বিজয় মেলা শুরু হওয়ায় মৌসুমী ভ্যানু হিসেবে মামুনরা রাতের বেলায় মেলার মাঠে ফেরি করে অতিরিক্ত টাকা আয় করে।

বুধবার রাত সোয়া ৮টার দিকে গাজীপুর রাজবাড়ি মাঠে জেলা প্রশাসন আয়োজিত মাস ব্যাপী বিজয় মেলায় বিজয়ের ৪৪বছরের বিজয় উৎসব করতে গিয়ে থমকে গেলাম। আঁখি আলমগীরের গান শুনতে স্বপরিবারে অস্ংখ্য পরিবার মেলার মাঠে উৎসবে ব্যাস্ত। প্রত্যেকেই প্রিয় সন্তান যা চাচ্ছে তাই কিনে দিচ্ছেন। যে কোন  মেলায় বাবা মার সাথে সন্তানেরা ঘুরতে সবচেয়ে বেশী আনন্দ পায়। শিশুদের আনন্দ বিনোদনের জন্য যা যা দরকার সবই আছে মেলায়। তাই সূযোগটিকে কাজে লাগাতে বাবা মা ও সন্তান কারো যেন কোন কমতি নেই। সবাই উৎসব ও আনন্দে ভাসছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধমে অর্জিত আমাদের  স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয় উৎসবে। কারো দিকে কারো যেন একটু অন্য দৃষ্টিতে চেয়ে দেখার সূযোগ নেই। সবাই সবাইকে নিয়ে মহাব্যস্ত।

নিজের শিশু সন্তানদেরকে নিয়ে বিজয় মেলায় ঘুরে ঘুরে পিতা মাতা কাপড় চোপড় খেলনা কিনে দিচ্ছেন। কখনো হালকা খাবার আবার কখনো বা ভাসমান ফেরিওয়ালার চা। চায়ের সাথে মুড়ির ছোট ছোট প্যাকেট শীতের আমেজকে উপভোগ করতে সহায়কও বটে। প্রতিদিনের তুলনায় গতকাল বিজয় মেলায় দর্শক সমাগম কম হয়নি। এরি মধ্যে মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল আঁখি আলমগীরের আগমন।

এই অবস্থায় আমিও হাঁটছি কয়েক বন্ধুর সাথে। হঠাৎ চোখ পড়ল ১০ বছরের ছোট শিশু মামুনের দিকে। হাতে ও কাঁধে চা ও মুড়ি। নিজের ওজনের চেয়ে জিনিসপত্রের ওজন বেশী হওয়ায় কোন মতে হাঁটছে শিশু মামুন। হাঁক ডাকছে ওই চা মুড়ি —-চা মুড়ি।

মামুনকে ডাকলাম। তার সাথে একান্তে কথা বললাম। ফিস ফিস করে। কিন্তু বেচা কেনার মোক্ষম সময় হওয়ায় সে আমাকে দ্রুত বিদায় করতে চাচ্ছে বুঝলাম আমি। তাই একশত টাকার একটি নোট দিয়ে বললাম আমি কিছু খাব না। এই টাকাটা তোমাকে দিলাম। বিজয় উৎসব করার জন্য। তখন সে আমাকে একটু সময় দিল। ১০ মিনিট হবে।এই সময়ে  বিবেকের তাড়নায় হাঁপাতে থাকা মামুনের কাঁধ থেকে চায়ের ফ্লাক্স নামিয়ে ছবি তুললাম। যেন জাতি লজ্জা পেয়ে মাথা হেড না করে।

মামুন বলল, তার বয়স ১০ বছর। পিতার নাম গোলাম হোসেন। বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুরে। মা বাবা চার বোন ও দুই ভাইয়ের সংসার। বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। বাকী সবাই গাজীপুর শহরের রথখোলার ঢাল নামক স্থানে জনৈক হাজী সাহেবের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। পরিবারের সবাই কাজ করেন। বোনরা পোষাক শ্রমিক। মা আনোয়ারা বেগম ঝিয়ের কাজ করেন। সারাদিন ফেরি করে যা পায় রাতে মায়ের কাছে দিয়ে আরামে ঘুমিয়ে পড়ে মামুন। লেখা পড়ার সাথে তার কোন পরিচয় নেই। কারণ এই বয়সে যখন শিশুরা স্কুলে যায় মামুনদের মত শিশুরা এক মুঠো খাবারের জন্য ফেরি ওয়ালার কাজ করে। সকালে স্কুলের গেটে ও বিকালে জনবহুল জায়গায়। স্কুলের পোষাক পড়ে একই বয়সের শিশুরা যখন স্কুলে প্রবেশ করে মামুন তখন সমবয়সীদের কাছে মুড়ি বিক্রি করে। শিশুরা মুড়ি খেতে খেতে স্কুলে প্রবেশ করে আর মুড়ির টাকা দেয় বাবা ও মায়েরা। একই বয়সী শিশু যখন মামুনের নিকট থেকে স্কুলের পোষাক পড়া অবস্থায় মড়ি খেতে খেতে দৌঁড়ঝাঁপ করে তখন মামুন হয়তবো চেয়ে চেয়ে দেখে। মুড়ির টাকা যখন বাবা মায়েরা দেয় মামুন তখন নিজের বাবা মায়ের অবস্থান চিন্তা করে। এই ভাবেই কেটে যায় মামুনদের দিন।

তবে একটি জায়গায় মামুন ভাগ্যবান। যেখানে তার জন্ম হয়েছে সেখানেই জন্ম নিয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান রাষ্ট্রপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ । যেখানে সে ফেরিওয়ালার কাজ করছে সে স্থানটি বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী এড. আ ক ম মোজাম্মেল হকের  নিজ জেলা ও তার বাসার কয়েকশ গজের মধ্যে। আর একই জেলার বাসিন্দা ও নারী শিশু মন্ত্রনালয়ের বর্তমান প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। ফলে মামুনের বয়সটি তারাও পার করেছেন স্থান দুটিতে এই ভেবে মামুন খুশি থাকতে পারে। তাই ওই তিন রাষ্ট্রচালকদের লাল সালাম দিতে পারে মামুন।

ক্ষুদা ও দারিদ্রমুক্ত একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে আমাদের কতটুকু চাহিদা পূরন হয়েছে জাতি বলতে পারবে। তবে এখনো যারা দেশ স্বাধীন করেছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফেরিওয়ালার কাজ করেও জীবিকা নির্বাহ করছেন। ঝড়ে পড়া শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন এমন অনেক সরকারী ও বেসরকারী দপ্তরও কাজ করছে। শিশুদের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রনালয়ও আছে। ওই শিশুদের জীবন মান উন্নয়ন ও লেখা পড়া করে ভবিষৎ মানুষ করতে সরকার, বেসরকারী সংস্থা এমনকি জাতিসংঘও কাজ করছে। শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও পুনর্বাসনের জন্য ওই সব প্রতিষ্ঠানের চিৎকার চেঁচামেচিতে মিডিয়া সারা বছর সরব থাকতে বাধ্য হয়। কিন্তু মামুনদের দেহ থেকে নিজ ওজনের চেয়ে বেশী ওজনের চা ও মুড়ির জিনিস নামার লক্ষন নেই।  এমনকি তাদের গায়ে স্কুলের পোষাক আর হাতে নতুন বইও উঠছে না। বরং সম বয়সী এক শিশুর অতিরিক্ত খাবার ও স্কুল ব্যাগ বহন করছে রোগ্ন দেহের অন্য একটি শিশু। কোথাও একটি শিশুর পরিচর্যা করছে আরেকটি শিশু ও তার পরিবার। এই দশা থেকে ৪৪ বছরে আমাদের মুক্তি মিলেনি। জানিনা কখনো মিলবে কি না।

 

ড. এ কে এম রিপন আনসারী

এডিটর ইন চীফ

গ্রামবাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *