এতকাল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এসেছে শোক, অভিমান, ক্রোধ, হতাশা ও দীর্ঘ বঞ্চনার প্রতিভূ হিসেবে। স্বজন হারানোর বেদনার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে দেখে হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে জাতি। কিন্তু এবার বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায় অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী আলবদর কমান্ডার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর এ দিবসটি পালিত হয়েছে নতুন প্রেক্ষাপটে। গতকাল সোমবার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে তাই জনতার ঢল নেমেছিল মিরপুর ও রায়েরবাজারের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক, পেশাজীবী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেওয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবিও জানান তারা।
গতকাল সোমবার সকাল ৮টা ৫ মিনিটে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ প্রথমে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। তারা দুজনই শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে নির্দিষ্ট সময় দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। সেনাবাহিনীর একটি দল সশস্ত্র সালাম জানায়। বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, বেগম মতিয়া চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের, শাজাহান খান, মাহবুবউল আলম হানিফ, মির্জা আজম প্রমুখ তার সঙ্গে ছিলেন।
এর আগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আসলামুল হক আসলাম প্রধানমন্ত্রীকে স্মৃতিসৌধে স্বাগত জানান। সেখানে পেঁৗছেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পরপরই জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় স্মৃতিসৌধ। গাবতলী ও মাজার রোড এলাকায় ভোর থেকেই ঢল নামে মানুষের। এতে স্বাভাবিক যান চলাচলও ব্যাহত হয়।
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। এ সময় বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, রুহুল কবির রিজভী, ফজলুল হক মিলনসহ বিভিন্ন নেতা তার সঙ্গে ছিলেন। বিকেল ৪টায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
স্মৃতিসৌধের উত্তর পাশে শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে আয়োজন করা হয় চিত্রপ্রদর্শনী ও কবিতা আবৃত্তি। সন্ধানীর উদ্যোগে ছিল স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির আয়োজন।
রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধেও সকাল থেকে শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় করেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এর আগে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে প্রথম প্রহরে কয়েকটি সংগঠন মোমবাতি জ্বালিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। সকালে শুরু হয় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের উদ্যোগে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা। একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে এই বধ্যভূমিতে যেভাবে ফেলে রাখা হয়েছিল, অভিনয়ের মাধ্যমে মূল বেদির পাশে সেই দৃশ্য তুলে ধরে কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের সদস্যরা। পরিবারের সদস্যদের নিয়েও অনেকে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে যান। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী মিরপুর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আজকে ১৪ ডিসেম্বর অন্য রকম। কারণ আলবদর কমান্ডার মুজাহিদকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে দেখেছি।’
বুদ্ধিজীবী হত্যায় দণ্ডিত যেসব হত্যাকারী বিদেশে অবস্থান করছে তাদের ফেরত আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে জাহিদ রেজা নূর ।
রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আজকে ২০১৫ সালে এসে পাকিস্তান বলছে, ১৯৭১ সালে তারা কোনো গণহত্যা চালায়নি। এটা নির্জলা মিথ্যা। এ জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক রাখা উচিত নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট আজ অপরাহ্নে বসে পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক রাখার বিষয়ে পর্যালোচনা করবে।’
রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধে প্রজন্ম ৭১-এর উদ্যোগে শ্রদ্ধা জানানোর পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সরকার যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করবে এবং জামায়াতের রাজনীতি করার কোনো অধিকার থাকবে না।’
মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা স্বাধীনতা লাভের আগ মুহূর্তে জাতিকে মেধাশূন্য করতে যারা পাকিস্তানের দোসর হয়ে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, সে সব শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে, রায়ও কার্যকর হয়েছে।’
রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ চত্বরে মানববন্ধনের আয়োজন করে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ‘৭১। সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘পাকিস্তান তাদের কৃতকর্মের জন্য অবিলম্বে ক্ষমা না চাইলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।’ মানববন্ধন শেষে সংগঠনের সদস্যরা পাকিস্তান হাইকমিশনে প্রতিবাদলিপি দিতে যাত্রা করেন।’
এদিকে জাসদ (ইনু) সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ১৪ দলের শরিক দল মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানায়। এ ছাড়া শ্রদ্ধা জানায় সিপিবি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জাকের পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব মহিলা লীগ, ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, যুবমৈত্রী, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক জোট, জাসাস, যুবদল, মহিলা দল, ছাত্রদল, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাচিপ, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, সম্মিলিতি সাংস্কৃতিক জোট, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, শ্যামলী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা কৃষিবিদ পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন।
এদিকে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন: জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশ আয়োজিত বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। ডিইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আতিকুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান। ডিইউজে সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদের সঞ্চালনায় বক্তৃতা করেন আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, খায়রুজ্জামান কামাল, তরুণ তপন চক্রবর্তী, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ।
এদিকে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) অপর অংশ জাতীয় প্রেস ক্লাবে আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভায় বক্তারা বলেন, একাত্তর সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। এদের কয়েকজনের বিচার সম্পন্ন হয়ে শাস্তিও কার্যকর হয়েছে। ডিইউজে সভাপতি এলাহী নেওয়াজ খান সাজুর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম চৌধুরী, গোলাম মহিউদ্দিন খান, খায়রুল আলম বকুল, আমিরুল ইসলাম কাগজী, সৈয়দ মেসবাহ উদ্দিন প্রমুখ।
ডিআরইউ: সাগর-রুনি মিলনায়তনে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত ‘স্বজনদের স্মৃতিতে’ অনুষ্ঠানে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কালক্ষেপণ ও তাদের আড়াল করায় জামায়াতের পাশাপাশি বিএনপিরও বিচার দাবি করেন। সংগঠনের সভাপতি জামাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক এসএম আনোয়ারা বেগম, ডিআরইউ সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ, সাবেক সভাপতি শাহেদ চৌধুরী প্রমুখ।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করে। এসব কর্মসূচির মধ্যে ছিল আলোচনা সভা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোতে কালো পতাকা উত্তোলন, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জমায়েত, জগন্নাথ হল স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফজলুল হক মুসলিম হলে শিখা প্রজ্বালন, তথ্যচিত্র প্রদর্শনী প্রভৃতি।