দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। দুর্নীতি মামলায় দায়মুক্তির হারও বাড়ছে। দুর্নীতি দমন অভিযানে কিছুটা ভাটার টান লক্ষ্য করছেন অনেকেই। তারা মনে করেন, দুদককে আরও নির্ভয় হতে হবে। তাদের মতে, অভিযান জোরদার করা না হলে দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা সম্ভব হবে না। দুদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিপরায়ণদের বিচারের মুখোমুখি না করে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ নথিভুক্ত করে পুঙ্খানুপঙ্খ তদন্ত ছাড়াই অভিযুক্তদের ছেড়ে দেওয়ার হার বেড়েছে।
আজ বুধবার আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস-২০১৫। এ উপলক্ষে আগামী দিনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছে দুদক। সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। গণশুনানির মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। দুর্নীতি বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে চালানো হবে অভিযান। বিচারের আওতায় আনা হবে রাঘববোয়ালদেরও।
দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান সমকালকে বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। পরে আদালতে চার্জশিট পেশ করা হয়। অনুসন্ধানে অনেক ক্ষেত্রে আদালতে আমলযোগ্য দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায় না। সেসব ক্ষেত্রে অভিযোগগুলো পুনঃঅনুসন্ধান করা হয়। এর পরও প্রমাণ না পাওয়া গেলে তখন অভিযোগটি নথিভুক্ত করে অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। দুদক কাউকে ছেড়ে দিচ্ছে, এটা সঠিক নয়। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দুর্নীতি দমন অভিযান থমকে দাঁড়িয়েছে, তা মনে করি না। দুর্নীতির বড় বড় অভিযোগ বলতে যা বোঝায় এখন সে রকম কিছু নেই। এ জন্য একটু ঝিমানো মনে হয়। আমরা স্বাধীনভাবেই আমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, এবারের আন্তর্জাতিক দুর্নীতি প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নতুন করে শপথ নেওয়া হবে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতরা যত প্রভাবশালী হোন না কেন, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সর্বস্তরের জনগণ, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মকে জাগ্রত করতে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সততা সংঘে’র কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে।
দুদক কমিশনার নাসির উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, দেশের মানুষ যাতে সংবিধান অনুযায়ী সেবা পান, সে লক্ষ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের গণশুনানির মুখোমুখি করা হচ্ছে। আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে এর সুফল পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন অপরিহার্য। দুর্নীতি দমনে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। যারা দুর্নীতি করে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবের কারণে তাদের বিচার হয় না। কারও প্রতি ভয় বা করুণা প্রদর্শন না করে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। দুর্নীতিপরায়ণদের বিচারের পরিবর্তে পুরস্কৃত করার সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে।
দুদকের অভিযান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান, মামলা ও চার্জশিটের সংখ্যা আগের চেয়ে কমে গেছে। কমে গেছে অভিযুক্তদের সাজার হারও।
দুদক সূত্র জানায়, গত বছর দুদকের ৫৯ শতাংশ মামলায় খালাস পেয়েছেন আসামিরা। একই বছরে সাজা হয়েছে ৪১ শতাংশ মামলায়। এর আগের বছরের তুলনায় গত বছর খালাসের হার বেড়েছে। ২০১৩ সালে ৫৪ শতাংশ মামলায় আসামিদের খালাস দেওয়া হয়েছে। একই সময়ে সাজা হয়েছে ৪৬ শতাংশ মামলায়। মামলা-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আসামিদের খালাসের হার ক্রমে বাড়ছে।
বর্তমানে ঢাকায় কমিশন আমলে দায়ের করা বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৮০৪টি। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে দুর্নীতি দমন ব্যুরো আমলের ৩৭৭টি মামলা বিচারাধীন। ঢাকার বাইরে কমিশন আমলের বিচারাধীন মামলা দুই হাজার ২৪৮টি। একই সঙ্গে ঢাকার বাইরে ব্যুরো আমলের বিচারাধীন মামলা ৭২০টি।
গত নয় বছরের হিসাবে দুর্নীতির অভিযোগ নথিভুক্ত করে অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেওয়ার হার বেড়েছে। তুলনামূলকভাবে মামলার সংখ্যাও কমেছে। আদালতে চার্জশিট দাখিলের হারও কিছুটা কমেছে। কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের সময় ২০১২ সালে ৫২১টি মামলা দায়ের করা হয়। চার্জশিট পেশ করা হয় ৫৮৮টির। একই সময়ে ৩৮২টি অভিযোগ নথিভুক্ত করে অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। বর্তমান কমিশনের আমলে গত বছর দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করা হয় ৩২১টি, চার্জশিট পেশ করা হয় ৫৬০টি। একই বছরে ৪৯৯টি অভিযোগ নথিভুক্ত করে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তদের খালাস দেওয়া হয়।
বর্তমান কমিশনের সময় তুলনামূলক মামলার চার্জশিটের সংখ্যা কমে এলেও বেড়েছে অভিযুক্তদের ছেড়ে দেওয়ার হার।
সূত্র জানায়, ২০১২ সালে হলমার্ক, ডেসটিনি, রেলে নিয়োগ দুর্নীতির মতো বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয় তাদের। এর মধ্যে হলমার্ক কেলেঙ্কারির নায়ক তানভীর মাহমুদ, ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমীনসহ কতিপয় আসামি জেলে আছেন। সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময় পদ্মা সেতু দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা করা হলেও বর্তমান কমিশন মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুমোদন করেছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। এ অভিযোগ থেকে চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয় নয়জনকে। এর মধ্যে রয়েছেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভঁূইয়াসহ অন্যরা। কানাডার একটি আদালতে পদ্মা সেতু দুর্নীতি ষড়যন্ত্র মামলার বিচারকাজ চলছে।
গত বছর ছয় এমপির নির্বাচনী হলফনামার অস্বাভাবিক সম্পদ অনুসন্ধান করে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। পরে তারা মুক্তি পান। এর মধ্যে সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান এমপি, সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান ও কক্সবাজার-৪ আসনের এমপি আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। একই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক এমপি, ঢাকা-১৪ আসনের এমপি আসলামুল হক এবং রাজশাহী-৪ আসনের এমপি ও এনা গ্রুপের কর্ণধার এনামুল হককে।
দুদক সূত্র জানায়, চলতি বছরে দুদক বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির মতো বড় অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করলেও প্রধান অভিযুক্ত ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে বাদ দিয়েই মামলা করেছে। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার সাবেক এক চেয়ারম্যানকে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ থেকে এবং পুলিশের রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সের (আরআরএফ) কমান্ড্যান্ট মিজানুর রহমানকে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের নথিভুক্তি ও চূড়ান্ত প্রতিবেদনের হার বেড়ে যাওয়ায় ছোট, মাঝারি অনেক অভিযুক্ত ছাড়া পেয়েছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদার করতে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম ঢেলে সাজানো হলেও এখন পর্যন্ত অভিযান জোরদার করা হয়নি।
এবারের আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসে প্রতিপাদ্য ‘ছিন্ন করো দুর্নীতির শৃঙ্খল’। বাংলাদেশে ‘দেশপ্রেমের শপথ নিন, দুর্নীতিকে বিদায় দিন’_ এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে দুদক। ‘জাগ্রত বিবেক, দুর্জয় তারুণ্য_ দুর্নীতি রুখবেই’ এই স্লোগান সামনে রেখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
দিবসটি পালন উপলক্ষে দুদক, দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) অধিভুক্ত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশসহ (টিআইবি) অন্যান্য সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শোভাযাত্রা, মানববন্ধন, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।