রাজললক্ষ্মীর অভিশাপের জীবন। তার গানের সুরে, নাচের মুদ্রায় অভিমান আর অনুতাপের আভাস। সেই অবুঝ প্রেমের বয়সে যার গলায় বঁইচির মালা পরিয়েছিল, এই বাইজি জীবনের সব একান্ত সময়ে মনে প্রাণে ছিল তার দেবতুল্য ছবি। জীবনের যত সুরসাধনা, নৃত্যকলা, রূপের খ্যাতি, তার চেয়েও বড় সাধনার নাম শ্রীকান্ত। সেই পুরুষের পায়ে মুখ রেখে, চোখ তুলে তার মুখের দিকে চেয়ে সেই সাধনাকে পুজার নামান্তর করে প্রকাশ করে।
‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে,
শত সাধনায় এমন ভাগ্য মেলে।’
এই গানের কথা আর সুরে- তাল মিলিয়ে শ্রীকান্তের গলায় গাঁদা ফুলের মালা পড়ে। আরতি নাচের ঢঙে পবিত্র প্রেমের নিবেদন করে রাজলক্ষ্মী। গানের সুর অসাধারণ মায়াময়। একজন নারীর প্রেমের নিবেদন, মায়া, নির্ভরশীলতা, সাধনা, স্বপ্ন, আরতি , পুজার মতোন নৈবেদ্য আমাদের কানে মধুর শোনায়। যত নরম, যত মিহি, যত নিবেদন থাকে মেয়ে কণ্ঠের গানে, আমরা তত বেশি সৌন্দর্যের স্বীকৃতি দেই। যত মিষ্টি করে গাওয়া সম্ভব শিল্পী গেয়েছেন। সুরের মাধুর্য অস্বীকার করা অসম্ভব। গীতিকার এমন একটা গান লিখেছেন কাহিনীর প্রয়োজনে। রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত চলচ্চিত্রের কাহিনীতে রাজলক্ষ্মীর অবস্থান এমন কারণ শরৎচন্দ্র তাঁর শ্রীকান্ত উপন্যাসে রাজলক্ষ্মীকে এভাবেই দেখিয়েছেন। তিনি তো ঔপন্যাসিক। একজন সফল কাহিনী রচয়িতা হিসেবে তৎকালীন সমাজের মোটামুটি সত্যিকারের অবস্থা তিনি তুলে ধরবেন এমনই স্বাভাবিক।
কিন্তু প্রভাব বলে একটা ব্যাপার থাকে। সমাজের, মানুষের জীবনের প্রভাবে যেমন চলচ্চিত্র বা চলচ্চিত্রের গানের সৃষ্টি, তেমনি এই গানগুলোও তো কোন না কোন ভাবে সমাজকে, মানুষের মন , বিশ্বাসকে প্রভাবিত করে। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় ‘মুখ ও মুখোশ’। পঞ্চাশ পরবর্তী চার দশক ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের গানের দাপুটে যুগ। ষাট, সত্তর, আশি আর নব্বই দশকে অনেক চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। অতি উৎসাহীরা রেডিও শুনে লিখে ফেলত গানের কথা। আর তখনকার শ্রোতার একটা বড় অংশ ছিল নারী। এটুকু অনুমান করা মনে হয় অন্যায় নয় যে- সাবিনা ইয়াসমীনের জননন্দিত কণ্ঠে যখন ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই, আমি মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো জোছনা ঝরিয়ে যাই’ এর মতো আত্মত্যাগী গান সুন্দর সুরে বাজত, অসংখ্য সাধারণ মেয়ে তাদের নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া বা ঘটতে যাওয়া ক্ষতিকর ত্যাগকে বরণ করার জন্য একধরণের অনুপ্রেরণা পেত। পিয়ানোয় হাতরাখা শাবানার স্নিগ্ধ রূপ আর সহ্য করার ক্ষমতা দেখে অনেক মেয়েই তাদের অধিকার ভুলে যেত হয়তো, হয়তো অনেকেরই মনের কথা হয়ে যেত, ‘আমি নীরবে ভালো যে বেসে নিজেকে পোড়াতে চাই।’
উল্লেখিত দু’টি গানের ই গায়কি, সুর, সঙ্গীতায়োজন মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো, জনপ্রিয় এবং জাতীয় স্বীকৃতি প্রাপ্ত। মানুষ তাই গানগুলো মনভরে শুনল। ভালো গান ভালোবাসল। আপন করে নিল। সমাজের, জীবনের, সংস্কৃতির একটা অংশ হয়ে থাকল গানগুলো। কিন্তু, এর বাইরেও কি কিছু থাকা উচিত ছিল না? একথা অস্বীকার করতে বাধা নেই যে, এটাই বাস্তব, সমাজের জন্য চরম সত্য। কিন্তু চলচ্চিত্রের কাজ কেবল বাস্তবতা তুলে ধরাই নয়; বিকল্প বাস্তবতা কিংবা বাস্তবতার যথার্থতা মূল্যায়ন।’
২.
বাঙালির একটা বিশাল আয়তনের আর মহাগর্বের ঐতিহ্য আছে। এই ঐতিহ্যের জগতে এখনও পুরোনো মুনি-ঋষির বিদেহী আত্মা বাস করে। মধ্য যুগের কবিগণ, বঙ্কিম বাবু, শরৎ চন্দ্র, বিদ্যাসাগর, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এখনও কথা বলেন । মহাভারত, রামায়ণ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, কোরান, মুসলিম শরীফ, বিষাদসিন্ধু এই গ্রন্থগুলো আমাদের বাঙালি সমাজের ঐতিহ্যের অনেক বড় একটা অংশ নির্ধারণ করে দেয়।
ঐতিহ্য ধারণ করা, স্মরণে রাখা সাধারণ অর্থে ক্ষতিকর বা নিন্দনীয় হতে পারে না। কিন্তু যখন নিজস্ব সংস্কৃতিতে বিশ্বাস মানেই দাড়ায় অতীতের সামাজিক নিয়মগুলো কোনভাবেই পরিবর্তনযোগ্য নয়, তখন সেই ঐতিহ্য ধারণের অন্য নাম গোঁড়ামি। ধর্মীয় গোঁড়ামির সহযোগী , অনেক সময় তার চেয়েও মারাত্মক, হল আমাদের বাঙালি- প্রতিক্রিয়াশীলতা। এককথায় বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যে আমরা অধিকাংশ মানুষ অন্ধের মতোন বিশ্বাস করি। চোখে দেখি, কান পেতে শুনি দুনিয়ার অনেক জায়গায় বিশাল সব পরিবর্তন ঘটে। আমরা কিছু পরিবর্তনে বাহ্বা দেই, উচ্ছ্বাস দেখাই। আবার অনেক পরিবর্তনে ‘ছি: ছি:’ করি। বাঙালির নাক উঁচু স্বভাব সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পায় লৈঙ্গিক ব্যবস্থার কোন বড় রকমের বিবর্তনে। নারীর জীবনধারণের রীতিনীতি প্রশ্নে অধিকাংশ বাঙালি ( এমনকি উচ্চশিক্ষিত ও প্রচলিত অর্থে আধুনিক) পুরুষের চিন্তাভাবনায় এখনও কাজ করে বহু যুগ ধরে চলে আসা ঐতিহ্য আর সংস্কার।
সেই প্রাচীণ যুগে বিভিন্ন কাব্যে বা ধর্মীয় গ্রন্থে নারীদের মনে করা হতো পুরুষের চেয়ে সবক্ষেত্রে অধম, পুরুষের নিয়ন্ত্রানাধীন, মুখাপেক্ষী। ‘ হিন্দু ঋষিরা আর বাইবেলের সন্তরা এ-বিষয়ে ( নারীর অধ-অবস্থান) একমত; নারীকে তারা বিন্যস্ত করেছেন শিশু আর উন্মাদের শ্রেণীতে। মনুর [৯:৩] বিধানে নারী চিরস্বাধিকারহীন অসহায় শিশু: ‘নারীকে কুমারীকালে পিতা, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্ররা রক্ষা করবে, নারী কখনও-ই স্বাধীন থাকার যোগ্য নয়।’
বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের বাংলা চলচ্চিত্রেও আমরা এর খুব বেশি পরিবর্তন বা ব্যতিক্রম দেখিনা। ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া মধুমিলন ছবির ফেরদৌসি রহমানের কণ্ঠের শ্রোতাপ্রিয় একটি গানে নারীর অসহায় দশা আর পুরুষমুখাপেক্ষিতা ফুটে উঠেছে এভাবে:
‘কথা বল না বল ওগো বন্ধু, ছায়া হয়ে তবু পাশে রইব।
আমি অভাগিনী শুধু যে তোমারই, যতই ব্যাথা দেবে সইব।’
ইসলামের তখন পূর্ণ বিকাশকাল। ১০৭৭ বা ৭৮ সালে তদানীন্তন পারস্যের জিলান প্রদেশের এক ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেন ‘বড়পীর’ খ্যাত ইসলাম-প্রচারক আব্দুর কাদের জিলানী। তাঁর মায়ের জীবনধারণ নিয়ে বিভিন্নধরণের কিংবদন্তির প্রচলন আছে আমাদের বাঙালি মুসলিম সমাজে। ধারণা করা হয় অবরোধবাসিনী এই পতিব্রতা নারী কোনদিন ঘরের বাহির হন নাই। আমাদের মুসলমান নারীদেরকে একসময় সেই শিক্ষাই দেয়া হতো ( বা এখনও দেয়া হয়)। একটা সময় ঘরের বাহির তারা হতে পারত না। এই অবস্থার অনেকখানি পরিবর্তন হলেও নারীর স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রবল বিপত্তি হয়ে অনেক ধর্মীয় সংস্কার এখনও আমাদের মাঝে প্রকট। ধর্মে উল্লেখ নাই অথচ ধর্মের রীতি বলে মানা হয় , এমন ভুল বিশ্বাসও অপ্রয়োজনীয়ভাবে আমাদের ঢাকার সিনেমার গানে এসেছে। কবরী অভিনীত আরাধনা ছবিতে ব্যবহৃত হয় শাম্মী আখতারের গাওয়া, ‘আমি তোমার বধূ, তুমি আমার স্বামী/ খোদার পরেই তোমায় আমি বড় বলে জানি’ গানটি । সৃষ্টিকর্তার পরেই স্বামীর সম্মান এইধরণের কোন ক্রমাবস্থান কোরানে নাই, শুদ্ধ হাদিস সংরক্ষণকারীরা কখনও এমন কথা উল্লেখ করেন নাই। । আবার ‘আরাধনা’ ছবিতে স্ত্রীর প্রেমের গাঢ়ত্ব, অবুঝ নিবেদনের গভীরতা বোঝানোর জন্য গানের এমন কথার তেমন প্রয়োজন ছিল না। গানটি জনপ্রিয় হয়েছে হয়তো সুরের জন্যে কিন্তু কথাগুলো নিশ্চয়ই অনেকের মনে গেঁথে গেছে, অনেকের কাছেই সত্য এবং মান্য বলে মনে হয়েছে।
বাঙালি প্রগতির সবচেয়ে বড় আদর্শ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতা, গান, গল্প, নাটক, উপন্যাসের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে, বাঙালির জীবনকে জাতে তুলেছেন, সম্মানিত করেছেন, অনেক কিছু চিনিয়েছেন , জানিয়েছেন। কোন মতামত প্রমাণের জন্যে রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃত করলে তাই আমাদের অধিকাংশেরই আর তেমন কোন সন্দেহ জাগে না।
দেশপ্রেম, প্রার্থনা, আত্মত্যাগ, আত্মবিশ্বাস, রোমান্টিক প্রেম ইত্যাদি বিষয়ে অসামান্য দার্শনিক সেই কবিগুরুও তাঁর শক্তিশালী কলমে লিখলেন, প্রচার করলেন ‘ভারতীয় নারীর সুখের রূপকথা: ‘ আমরা তো দেখতে পাই আমাদের দেশের মেয়েরা তাঁদের সুগোল কোমল বাহুতে দু-গাছি বালা প’রে সিঁথির মাঝখানটিতে সিঁদুরের রেখা কাটে সদাপ্রসন্ন মুখে…কখনো কখনো অভিমানের অশ্রুজলে তাঁদের নয়নপল্লব আর্দ্র হয়ে আসে, কখনোবা ভালো বাসার গুরুতর অত্যাচারে তাঁদের সরল সুন্দর মুখশ্রী সকরুণ বিষাদে ধারণ করে,…যা হোক আমাদের গৃহলক্ষ্মীদের নিয়ে আমরাতো বেশ সুখে আছি এবং তাঁরা যে বড়ো অসুখে আছেন এমনতরো আমাদের কাছে তো কখনও প্রকাশ করেন নি, মাঝের থেকে সহস্র ক্রোশ দূরে লোকের অনর্থক হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায় কেন।’
আমরা রবীন্দ্রনাথে অনেক বেশি বিশ্বাস রাখি। ঢাকার ফিল্মের গানের গীতিকারেরা তাঁর রোমান্টিসিজম, কল্পনারশক্তির কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তাই গৃহলক্ষ্মী, পুত্রবধূ, সহধর্মিনী, রজনীগন্ধা, বধূ-বিদায় প্রভৃতি চলচ্চিত্রের গানে রবীন্দ্রনাথের কথার প্রতিধ্বনি ওঠে। আমাদের নারীরা চোখের জলে ভিজে ভিজে ধৈর্য্যের পরীক্ষা দেয়। তারা স্বামীর আর সংসারের সুখের জন্যে নিজের সবকিছু বিসর্জন দেয়। কাহিনী জনপ্রিয় হয়। কাহিনীর সাথে মিলানো রোমান্টিক আর মনভুলানো গানে বাহ্বা পরে। গানের কথায় যে নারীমনের দুঃখ আছে , যন্ত্রণার দাগ আছে আমরা ভুলে যাই। সাবিনা ইয়াসমীন তাই কান্নাভেজা কণ্ঠে ‘দুঃখ আমার বাসর রাতের পালঙ্ক/ নিন্দা আমার প্রেম উপহার, সাতনরী হার কলঙ্ক’ গাইলেও বাস্তবের মা-বোন-স্ত্রী-পুত্রবধূ-ভাবি-মাসি-পিসিদের দুর্দশা আমাদের চোখে পড়েনা। রবীন্দ্রনাথের মতোন আমরা সেসব অবহেলা করি। মনে করি, হয়তো , এমন কষ্ট একটা মেয়ের জন্যে বড়ই স্বাভাবিক। বাহ! কী সুন্দর মিষ্টি দুঃখের গান তারা তবুও গাইতে জানে
৩.
‘… in our tradition bound society – women need to uphold the cultural traditions…like wear the Indian type of dress, visit temples, conduct poojas, maintain relationships with family (both own and in-laws), but men can generally do whatever they want… Bollywood tries to uphold some sort of unrealistic and artificial ÒidealÓ which unfortunately can be used as a stick to beat women with in real life.’ নিতা কুলকার্নি নির্দিষ্টভাবে হিন্দি প্রথাগত চলচ্চিত্রের সমালোচনার উদ্দেশ্য কথাগুলো লিখেছেন তাঁর ব্যক্তিগত ব্লগে। কিন্তু আমরা ঢাকার চলচ্চিত্রেও এর স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। আসলে ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া উপমহাদেশের বেশিরভাগ এলাকায় নারী সম্পর্কে সমান মাপের সংস্কার প্রচলিত। তাই করাচি, কলকাতা, মুম্বাই, ঢাকা, খুলনা সবখানেই প্রায় একই চিত্র। এই সব শহরে আদর্শ নারী বলতে বুঝায় লম্বা কালো কেশবতী, লাজুক চোখের, মাথায় বিনয়ের ঘোমটা দেওয়া, কথায়-চলনে যত বেশি সম্ভব নম্র এবং অপ্রতিবাদী কাউকে।
তাই লাহোরের চলচ্চিত্রে জেবা, শবনম, রানিকে আমরা যেভাবে উপস্থাপিত হতে দেখতাম, মুম্বাইয়ের রূপালি পর্দার রেখা, শর্মিলা ঠাকুর বা জয়া ভাদুরি তাঁদের থেকে খুব আলাদা কেউনা। তেমনি কোলকাতার সুচিত্রা সেন , সুপ্রিয়া দেবীর চলন-বলন বা পর্দা-উপস্থিতির সাথে গৃহলক্ষ্মী বা রজনীগন্ধার শাবানা, আরাধনা এবং আবির্ভাবের শর্মিলী আর কবরী, বা সহধর্মিনী ছবির দিতি কতখানি আলাদা? মুম্বাইয়ের ছবির ‘unrealistic and artificial ideal’ (অবাস্তব আর কৃত্রিম নীতিবোধ) যেমন সেখানকার বাস্তব নারীদের পরাজিত জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে, ঢাকার চলচ্চিত্রে নারী চরিত্রের অবমূল্যায়নও তেমনি সারাদেশে একধরণের অসচেতনতা বজায় রাখতে সাহায্য করে অনেকখানি। এখন না হয় প্লেব্যাক গানের সেই দাপুটে যুগ আর নাই। কিন্তু এমনও সময় ছিল যখন সাংসারিক, সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্র বাংলা চলচ্চিত্রের কাহিনী, তারকা বা গানের প্রসঙ্গ হামেশা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বিশেষ করে সত্তর, আশির পুরো দশক আর নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের গ্রামে বা মফস্বলে চলচ্চিত্রের গানের জনপিয়তা ছিল অন্য যেকোন গানের ধারার চেয়ে অনেক বেশি। ধরুন, আশি বা নব্বইয়ের বগুড়া বা কুমিল্লার একটা মেয়ে হয়তো রেডিও খুলে আত্মসমর্পণের ভাব, ভক্তি আর আবেগ দিয়ে ঝুমুর ছবিতে রুনা লায়লার গাওয়া ‘তুমি যে আমার প্রেমের অহংকার, নারী জীবনে স্বামী বড় অলংকার…প্রেমেরই ছোট্ট একটি ঘর আমায় দাও’ গানটি শুনছে। গানটা তার অসম্ভব ভালো লেগে গেল। আরও অনেকের মতো কথাগুলো তার মাথায়, মনে সংস্কারের মতোন গেঁথে যাওয়া অস্বাভাবিক না। আবার খুরশীদ আলমের বিখ্যাত গান ‘চুমকি চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে?’ শুনে,আমার বেশ ধারণা হয়, অনেক যুবক বা ছাত্র ইভ-টিজিংয়ে উৎসাহিত হয়েছে, গানটির রিমেক শুনে এখনও যেমন হয়।
৪.
গান তো কবিতা থেকে একেবারে আলাদা কিছু না। গীতিকাররা অবশ্যই কবি। তাঁদের কবিতায় তাল, ছন্দ, মাত্রার প্রাধান্য বেশি। শব্দগুলো হওয়া চাই নরম, সহজে উচ্চারণ করার মতোন। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল, মনে হয়, এ যাবতকালে সবচেয়ে বেশি বাংলা গান রচনা করে গেছেন। কবিতা আর গানের মিল যে কতখানি তা তাঁদের লেখার ধরণে বোঝা যায়। ‘সর্বহারা’ কবিতায় নজরুল লিখলেন,
‘ ব্যথার সাঁতার-পানি-ঘেরা
চোরাবালির চর,
ওরে পাগল! কে বেঁধেছিস
সেই চরে তোর ঘর?’
আবার প্রায় একই দৃষ্টিকোণ আর ধরণ মেনে ‘একূল ভাঙে ও কূল গড়ে’ গানে কবি লিখলেন-
‘ সেই নদীর ধারে কোন্ ভরসায়,
(ওরে বেভুল) বাঁধলি বাসা সুখের আশায়
যখন ধরল ভাঙন পেলিনে তুই
পারে যাবার ভেলা।’
রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার সোনার থালায় সাজাবো আজ’ গান, কবিতা দুইই। নজরুলের ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ গান হিসেবেও যথেষ্ট জনপ্রিয়। রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী সময়ে আধুনিক গান এবং আধুনিক কবিতা নামে দু’টি পৃথক ধারার সৃষ্টি হয়। আধুনিক কবিতা প্রথাগত সব নিয়ম ভেঙে ৬০, ৭০ আর ৮০’র দশকে বিপ্লব বলে গণ্য হতে থাকে। ‘আধুনিক বাংলা গান নামে যা চালু হল, তা আধুনিক সাহিত্য বা আধুনিক কবিতার সম্পূর্ণ বিপরীত’।
বিশেষ করে চলচ্চিত্রের গানে কুসংস্কার আর প্রথাগত, পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম মানার প্রবণতা বাড়তে থাকল ভয়ানকভাবে। শামসুর রাহমান, হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, তসলিমা নাসরিন অনেকেই যখন কবিতায় আধুনিক, বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আমাদের বাংলা চলচ্চিত্র তখন অনেক শক্তিশালী একটা মাধ্যম হয়েও এমন কোন স্বপ্নের ধারে-কাছে যায় নাই।
জুলি নামের এক চলচ্চিত্রে দেখানো হয় শবনম প্রথম জীবনে অত্যাচারিত হতে হতে, একটা সময় এসে প্রতিবাদী হয়। একে একে প্রতিশোধ নিতে থাকে। কিন্তু তার পুরো শক্তি আর অনুপ্রেরণা যোগায় একটা পুরুষ। বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নের মতোন কোন স্বাবলম্বী আর স্বাধীন গল্প জুলি বা এই ধরণের অন্য কাহিনীচিত্রগুলোতে পাওয়া যায় না। আবার, বাংলা চলচ্চিত্রে সবচেয়ে পরিচিত আর ব্যবহৃত দৃশ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, একটা মেয়ে প্রায় ধর্ষিত অবস্থায় চিৎকার করছে। হঠাৎ একজন শক্তিমান , ত্রাতা পুরুষের আবির্ভাব এবং মেয়েটার মুক্তি। এর পুনরাবৃত্তি প্রায় অসহ্য রকমের, প্রায় প্রতিটি মূলধারার ছবিতে এসেছে। গানের কথাগুলোও যেন এইধরণের সংস্কারের অন্ধ অনুকরণে ব্যস্ত।
অস্বীকার করার উপায় নাই যে কবিদের মতোন চলচ্চিত্রের গান রচয়িতারা স্বাধীনভাবে লিখতে পারেন না। কাহিনীকার, প্রযোজক, পরিচালকের অনেক নির্দেশনা মানতে হয়। প্রতিহিংসা ছবির কাহিনীর প্রয়োজনে প্রযোজক, পরিচালক এমন একটা ডুয়েট গান লিখতে বললেন যেখানে প্রেমিক আর প্রেমিকা বিয়ের বন্দোবস্ত হয়ে যাওয়ার খুশিতে পরস্পর গান গাইবে। মিলনের আনন্দ আর অধীর অপেক্ষার কথা জানাবে। সেইমতোন গীতিকার লিখলেন । কিন্তু অপ্রয়োজনীয় বৈষম্য-দোষ যাকে বলে, ছেলেটির জন্যে লিখলেন-
‘আজ থেকে সারাজীবন তুমি যে আমার,
পুরোপুরি দখলদারি পেয়েছি পেয়েছি তোমার।’
অর্থাৎ বিয়ে মানে মেয়েটি ছেলের সম্পদ অথবা সম্পত্তি হয়ে যাবে আমরণ। স্ত্রীর দেহ-ইচ্ছা-মন-ধর্ম-কর্ম সবকিছুতেই ‘পুরোপুরি দখলদারি’ করার সামাজিক, ধর্মীয়, পারিবারিক আইনগত অধিকার পায় ছেলেটি। যত বড়, যত গাঢ় প্রেমিক মন নিয়েই একজন পুরুষ-গীতিকার এমন কথা লিখুন না কেন, তিনি তাঁর এবং পরিবার-রাষ্ট্র-সমাজের আজন্মের প্রতিষ্ঠিত গোঁড়ামিকেই সুরের মাধ্যমে, প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কণ্ঠের মধ্য দিয়ে দিয়ে আরও পোক্ত করতে চেয়েছেন। অথবা তিনি অসচেতনভাবে, গা এলিয়ে লিখেছেন গানখানা। মেয়েকণ্ঠের জন্য তাঁর বরাদ্দ আরও ভয়াবহ । মেয়েটা যেন এমন অন্যায় দখলদারিত্ব মেনে নিয়েছে। ‘হুকুমজারি হয়েছে শুধু পাওনি অধিকার।’
হতে পারে ঘটতে যাওয়া বিয়ের আনন্দে আমাদের দেশের সাধারণ পুরুষ আর সাধারণ নারীরা এমন করেই প্রকাশ করে। সেক্ষেত্রে গানটাকে বাস্তবমুখী, জীবনমুখী বলে ধরে নেওয়া উচিত। নিলাম। কিন্তু প্রশ্ন হল, প্রতিহিংসার মতোন অ্যকশনধর্মী মেলোড্রামার গানের ক্ষেত্রে এই বাস্তবমুখিতা কতখানি জরুরি ছিল? মূলধারার চলচ্চিত্রে আমরা কতখানি বাস্তবনির্ভর ? চলচ্চিত্রের গানের ক্ষেত্রে তো বাস্তবতার মান প্রায় শুণ্য। কারণ, পর্দায় কোন বাদ্যযন্ত্রের নজির নাই কিন্তু তবলা, গিটার, বাঁশি, কীবোর্ড, হারমোনিয়ামসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজতে থাকে গানের সাথে, বেশ সুরেলা ভাব নিয়ে। দর্শকদের প্রায় সবাই জানে যে অভিনেতাদের ঠোঁটে তারা যেই গান শোনে তা অন্যের গাওয়া। মৌসুমি, দিতি বা ববিতার বেশ মানানসই অভিব্যক্তির পরেও মানুষ রুনা লায়লা আর সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠ ঠিকই ধরে ফেলে। তাহলে গীতিকারেরা যদি বার্তা বা সচেতনতামূলক, বৈষম্যহীন কথা লেখার স্বার্থে খানিকটা কল্পনাপ্রবণ হন বা বাস্তবের খানিকটা ঘষেমেজে দেখান, তাতে ক্ষতি কী? প্রতিহিংসার গানটা যদি এভাবে শুরু হতো ‘আজ থেকে সারাজীবন দু’জন দু’জনার/পাশাপাশি পথ চলার পেলাম অধিকার।’ কাহিনীর বিশেষ কোন ক্ষতি হতো না, সুরও বসানো যেতো আগের মতোই।
চলচ্চিত্রের গীতিকবিরা আধুনিকতা থেকে অনেক দূরের জগতের বাসিন্দা? নাকি তাঁরা কখনও সচেতনভাবে কিছু লেখেন নাই? তাঁদের কখনও মনে হয় নাই যে অনেক তো হল এবার একটা মেয়ের জন্যে লিখি; একটা মেয়ের মুক্তির গান দিয়ে অসংখ্য লিঙ্গ-বৈষম্য দূরে পাঠাই, বনবাসে? হয়েেতা এমন তাঁদের কোনদিন মনে হয় নাই। গীতিকারদের সিংহভাগ পুরুষ। তাঁরা চারপাশের ধর্ম, পরিবার, সমাজ, পুরুষের সব সংস্কার, গোঁড়ামিকে আজও হয়তো সর্বোত্তম সত্য বলে মানেন। তাঁরা উদার কবিতার মতো করে ভাবে না, তাঁরা আধুনিক সাহিত্যের ধার ধারেন না। চলচ্চিত্র মানেই বানিজ্য। চলচ্চিত্রের গানও তার অংশ। বানিজ্যে সফলতার মূল শর্ত জনতার মন ভোলানো। যা চিরায়ত, সকলের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, তাকে আরবারও উচ্চারণ করা সহজ, নিরাপদ আর ঝুঁকিহীন। জনপ্রিয় বিশ্বাসকে আঘাত করার সাহস দেখানোর মতোন লোক আমাদের মূলধারার চলচ্চিত্রে কোনদিন খুঁজে পাওয়া যায় নাই। সবাই ব্যবসা খুঁজেছে, জননন্দিত হওয়ার চেষ্টায় জীবন পার করেছে, মেধার ব্যয় করেছে। কিন্তু ব্যবসার বাইরেও, সহজ বিনোদনের বাইরেও চলচ্চিত্রের একটা বড় দায় আছে। সেই দায়িত্ব কেউ পালন করে নাই। কোন পুরুষ-গীতিকার তো নয়ই। শিল্প হিসেবে আমাদের মূলধারার চলচ্চিত্র যতখানি ব্যর্থ হয়েছে বারবার, চলচ্চিত্রের গানের দোষ ততখানি, বা তার চেয়েও বেশি। কদাচিৎ শোনা যায় দু’একটা নারীমুক্তির চরণ। কিন্তু উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তা কখনওই দাড়ায়নি।
নারী গীতিকারেরা যে কয়টা হাতেগোণা গান লিখেছেন তাঁর মধ্যেও একই রকম পুরুষের আধিপত্য । কবি খোশনূরের লেখা ‘তুই যে আমার মিলন মালারে বন্ধু পিরিতের নকশি সুতায় বেঁধে রাখি, হায় দমে দমে তোরে ডাকি’র মতোন গানেও কোন ধরণের বিদ্রোহের আভাস নাই। বরং নারী-গীতিকারদের লেখা গানগুলোতেও আত্মসমর্পণ ভাব বেশ স্পষ্ট।
৫.
প্রচলিত চলচ্চিত্রে গান ব্যবহারের নির্দিষ্ট কিছু ধরণ আছে। পুরুষ কণ্ঠের গানের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ ধরণ হলো নারীর রূপে ব্যাপক মুগ্ধতা প্রকাশ। খুবই জনপ্রিয় আর জীবনঘনিষ্ট এই ধারায় রচিত হয়েছে অজস্র গান। পছন্দের নারীর রূপ বর্ণনায় চিরাচরিত রীতির বাইরে তেমন কোন গান লেখা হয় নাই।
‘রূপ দেখে বলব কী?
ভাষা খুঁজে পাই না,
ঘরে যদি চাঁদ থাকে
আকাশের চাঁদ চাই না।’
যেন নারীর রূপ সবসময়ই চাঁদের মতোন স্নিগ্ধ। তাতে সূর্যের তেজ নাই। চাঁদ সূর্যের আলো ধার করে জ্বলে থাকে সে। নারীর চোখ, চুল, চিবুক, শরীর কেবল দেখার শোভা, চাঁদের আলোতে যেমন কোন দিন ধান শুকানো যায় না, বই পড়া দুরূহ। ফকির মজনু শাহ ছবির একটি গানে জাফর ইকবালের কণ্ঠ,
‘মেঘ কালো, ভ্রমরা কালো, আরো কালো মাথার চুল,
সেই না কালো লাগে গো ভালো , নারীর অঙ্গে ফুটলে ফুল।’
নারীদেহ পুরুষের চোখে ফুল। শোভা নিয়ে ফুটে থাকে। বাতাসের দোলা ছাড়া একেবারে নিশ্চল, চলে যাওয়ার ক্ষমতা এর নাই, কেবল ঝরে যেতে পারে। আর পুরুষ ভ্রমরের মতোন চাইলে যখন তখন মধু নিয়ে চলে যেতে পারে আরেক ফুলে।
এমন উপমার ফাঁদে বারবার ঘুরপাক খায় আমাদের গানের মূলধারা। কেউ কখনও বলে নাই একজন নারীর চোখের মনি কালো ভ্রমরের মতোন, নারীর কণ্ঠ ভ্রমরের মতোন গুনগুন করে উড়ে এসে পুরুষের ঘুম ভাঙায়। প্রকৃতিকেন্দ্রিক রোমান্টিসিজম আর প্রকৃতির নিয়মের দোহাই দিয়ে যুগের পর যুগ নারী-অপমানের গান নির্দ্বিধায় , আলগোছে লেখা হচ্ছে। আব্দুল আলিম, মাহমুদুন্নবী, আব্দুল জব্বার, খুরশীদ আলম,বশির আহমেদ, এন্ড্রু কিশোর প্রমুখের সুন্দর সুন্দর গলার স্বর ব্যবহার করে নারীর শরীরকে একঘেয়ে সৌন্দর্য বর্ণনায় ক্লিশে করে ফেলা হচ্ছে। ফুল, চাঁদের মতোন পরাধীন সবকিছুর সাথে তুলনা করে নারীর মানবজীবনকে অবহেলায় এড়িয় যাওয়া, মন ভুলিয়ে দমন করা বেশ সহজ!
৬.
‘পুরুষতন্ত্রের কারণে নারীর ভাবনা মূলত হয়ে পড়ে পুরুষেরই ভাবনা। পুরুষের ভাবনার ছকেই তখন নারীর জীবন আবর্তিত হয়। বিশেষ করে আধুনিক চিন্তা-চেতনার দ্বারা দীক্ষিত নয় যে-নারী, তার পক্ষে কখনই বিকল্প কিছু ভাবা সম্ভব নয়। আমাদের গ্রামীণ নারী এভাবেই পুরুষকে ধ্যানজ্ঞান মনে করেছে। তার ভেতরে গড়ে উঠেছে ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্যের বোধ।’
পুরুষ যখন ‘নারীর অঙ্গে ফুল’ ফুটলে তার বর্ণনায় ঢলে ঢলে পড়ে, নারীর প্রতিক্রিয়া কেমন তখন? ‘ মেঘ কালো, ভ্রমরা কালো, আরো কালো মাথার চুল/সেই না কালো লাগে গো ভালো , নারীর অঙ্গে ফুটলে ফুল।’ এর সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিক্রিয়া আসে, ‘সেই ফুলের মধু অঙ্গে শুকায় সজনি গো/ বয়েসের ভার মানে না।’ অর্থাৎ পুরুষ গীতিকারেরা নারীকণ্ঠগুলোকে যতটা সম্ভব নিজেদের কাজে লাগিয়েছেন। অনেক সময় বলা হয় এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের গানে মেয়েদের আধিপত্য। আসলে ব্যাপারটা সত্যি না। পাকিস্তানে নূরজাহান, মালা বেগম; ভারতে লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে; আমাদের এখানে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন দশকের পর দশক প্লেব্যাক জগতকে শাসন করেছেন বলে ধরা হয়। কিন্তু রুনা লায়লা বা সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠ ছাড়া যখন একটা বাংলা চলচ্চিত্রও মুক্তি পেতো না, তখনও কতখানি স্বাধীন ছিলেন তাঁরা? এমন কোন গীতিকার ছিল না যে তাদের কণ্ঠের সত্যিকারের মর্যাদা দিয়ে একটা-দু’টো নারীমুক্তির গান লিখে দেবে। তাঁরা সারাজীবন এদেশের মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব করে গেলেন গানে গানে, দুঃখ-আকুতি তুলে ধরলেন, কিন্তু কতবার আমরা তাঁদের দেখলাম পুরুষতান্ত্রিক গানের কথার কাছে হার মানতে? অনেকবার, অজস্রভাবে। একটা গানের খানিক বিস্তারিত কথা শিল্পীর নাম সহযোগে ব্যবহার করলে ব্যাপারটা মনে হয় অনেকটা বোধগম্য হবে। লাভ ইন সিঙ্গাপুর ছবির গান।
রুনা লায়লা: ঘরজামাই বানাবো তোমাকে,
পারবে না ফেরাতে আমাকে।
এই সিঙ্গাপুরে সংসার গড়ে দু’জনে
থাকব সুখে।
সুবীর নন্দী: স্বামী মানে ‘হাজব্যান্ড’।
হাজব্যান্ড মানে ঘরজামাই নয়
স্বোয়ামী হব। ওগো এবার আমার হাত ধরে চলনা দেশে।
ঘরণি বানাবো তোমাকে।
রুনা লায়লা: স্বোয়ামি বানাব তোমাকে।
মানে কী দাড়ায়? একটা মেয়ের জন্য ঘরণি হয়ে স্বামীর ঘরে যাওয়া স্বাভাবিক , পবিত্র কাজ। আর যদি একজন পুরুষ ঘরজামাই হয় তার জাত-কুল সকলই যায়। এর চেয়ে ডাকাতি বৈষম্য আর কী হতে পারে? অথচ এমন স্পষ্ট বৈষম্যের প্রতি বাংলা চলচ্চিত্রের গানের মাধ্যমে বারবার সমর্থন জানানো হয়েছে। ব্যবহৃত হয়েছে ঢাকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয়তম কণ্ঠগুলো। কোনদিন কোথাও কোন প্রতিবাদের উঙ্গিত উল্লেখযোগ্যরকমে পাওয়া যায় নাই। সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে সহস্রবার আত্মসমর্পনের গান তুলে দেয়া হয়েছে। আপনপর ছবিতে নারী কণ্ঠের প্রতি বৈষম্য, হোক না তা কাহিনীর প্রয়োজনে, একেবারে মারাত্মক। এই ছবিতে বশির আহমেদ আর সাবিনা ইয়াসমীনকে দিয়ে একই সুরের দু’টি গান রেকর্ড করা হয়। বশির আহমেদের কণ্ঠে-
‘পিঞ্জর খুলে দিয়েছি,
যা কিছু কথা ছিল ভুলে গিয়েছি,
যারে যাবি যদি যা।’
অসম্ভব জনপ্রিয় এই গানের সমন্তরাল সুরের আর বিপরীত কথার গানটি সাবিনা ইয়াসমীনের।
‘পিঞ্জর ছেড়ে যাব না।
দে আঘাত কত দিবি কিছু ক’ব না।
নে রে হার মেনেছি।’
শুধু এই গান না সাবিনা ইয়াসমীনের মিষ্টি কণ্ঠকে কাজে লাগিয়ে এই ধরণের অসহায় ভাবের গান অত্যধিক গাওয়ানো হয়েছে। বিরাজ বউ ছবিতে ‘আমার সকল চাওয়া তোমারই কাছে’, নতুন বউ ছবিতে ‘ আমি কপালে পরেছি স্বামীর সোহাগী চন্দন’, বন্দিনী ছবিতে ‘ ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকোনা… লাজে মরি মরি গো’, ‘ জোয়ারভাটায় ‘মন যদি ভেঙে যায় যাক যাক কিছু বলবনা’, নয়নমনি ছবিতে ‘চুল ধইরো না খোঁপা খুলে যাবে হে নাগর’ এইসব বহুল প্রচলিত আর কিংবদন্তিতুল্য গানগুলো বারবার নারীর অসহায়ত্বের ধারক ও বাহক হিসেবে উঠে এসেছে। যদি বাঙালি সমাজের সত্যিকারের চিত্র হিসেবে ধরি, তাহলে এই গানগুলো নারীমনের দুঃখ-যাতনায় সমবেদনার মতোন। কিন্তু এই সমবেদনায় ফল হয় উল্টো । কারণ চলচ্চিত্রের গানের মাধ্যমে ঢালাওভাবে, মিষ্টি কথায় , সুরেলা ভাবে এই সমবেদনা প্রকাশ করলে শ্রোতা-পুরুষের চোখ আরও অন্ধ হয়ে যায়, শ্রোতা-নারী আরও সহ্য করার শক্তি নিয়ে আত্মঘাতী মন প্রস্তুত করে।
চলচ্চিত্রের গানের আরেকটি জনপ্রিয় ধারা আছে। কাহিনীর প্রথমদিকে বাজানো হয় গানগুলো। নারীকণ্ঠের গান। গানের মূলভাব মেয়েটার পক্ষে আর একলা থাকা সম্ভব না। একজন পুরুষের অপেক্ষায় তার আর দিন কাটে না, রাত কাটে না। অথবা পছন্দের পুরুষটির কাছে নিজেকে সমর্পণের নানা ছল করে। অসংখ্য চলচ্চিত্রে রুনা লায়লার জন্য লেখা হয়েছে এসব কথার গান। রুনার কণ্ঠের আবেদনময়ী ভাবটাকে ব্যবহার করে দেখানো হয়েছে পুরুষের তুলনায় নারী অধিক কামুক। নারী তার দেহের ভার বহন করার যোগ্য না। মহাভারতের ‘অনুশাসন’পর্বে ঋষি বলেছেন, ‘স্ত্রীলোক স্বভাবতই রতিপ্রিয়…নিজের অভিলাষ পূরণ করতেই কারা ব্যতিব্যস্ত থাকে।’
এতকাল পরেও সেই মতবাদের প্রতিধ্বনি ওঠে ঢাকার সিনেমার গানগুলোতে। চন্দনদ্বীপের রাজকন্যায় ব্যাকুল নারীকণ্ঠ গায় ‘বসন্তেরই এমন দিনে মনের বাগান খালি, কোথায় গেলে পাবো বলো আমার সুজন মালী রে, একা একা ভালো লাগে না।’ গাড়িয়াল ভাই ছবিতে ‘তুমি কেমন গাড়িয়াল, শুধু টানো পরের মাল, হাতের কাছে থাকতে মানিক রইলা যে কাঙাল’, পাহাড়ি ফুল ছবিতে ‘পাহাড়ি ফুল আমি মৌরানি, হায় কেউ জানে না, রূপে আছে নেশা, চোখে ছলনা।’
পুরুষের যৌন আকাক্সক্ষার চেয়ে নারীর যৌনচাহিদাকে অনেক বেশি অশালীন আর বিকৃত দেখানোর জন্য, শিল্প-মানহীন গান তৈরী হতে থাকে। সেই যুগের বাহাদুর ছবিতে ‘রূপে আমার আগুন জ্বলে , যৌবনভরা অঙ্গে , প্রেমের সুধা পান করে যাও , হায়রে আমার দিওয়ানা’, দিয় যার শুরু। নব্বই দশকে চলচ্চিত্রের অশ্লীল কাহিনীহীন চিত্রায়ন যখন ফুলে ফেঁপে ওঠে, বাড়তে থাকে এধরণের গানের সংখ্যা। নারীর স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদাকে, অবহেলায় অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে, উপস্থাপন করা হতে লাগল পতিতাবৃত্তির ভাষায়। উদাহরণ, ‘বিচ্ছু আমার গায়ে কামড় দিল রে’, ‘ওরে ও দুষ্টু পানি এখন আমার ভরা জাওয়ানি’, ‘আমার ঘরেতে এলোরে রসেরই নাগর’, ‘কে নেবেরে কে নেবে আমি সোনার চাক্কা’, ‘ হে যুবক এদিকে তাকাও’।
একদিকে সাবিনা ইয়াসমীনের নরম কণ্ঠের দোহাই দিয়ে নারীর সকল বিদ্রোহ, অধিকারকে জমিয়ে বরফ-শীতল করে দেওয়া, অন্যদিকে রুনা লায়লার কণ্ঠের উচ্ছাস আর আবেদনময়ী ভাব ব্যবহার করে নারীকে কামুক, ছলনাময়ী করে উপস্থাপন করা। কোনভাবেই পুরুষ গীতিকারের চোখে নারী স্বাভাবিক না। তারা আলাদা, অন্যরকম। আকর্ষণীয় কিন্তু ছলনাময়ী। ধৈর্যশীল আবার দেহবিলাসী। আশ্চর্য রকমের এক সৃষ্টি যাকে বোঝা দায়। তাই যেমন ইচ্ছা লেখো। তার মনের ভাব জানার দরকার নাই। তার বিলাপে কান দেওয়া অনুচিত। লিখে যাও মন যা চায়। পুরুষ সব পারে। নারীর চিন্তাকে পুরুষের ভাষায় অনুবাদ করতে পারে; নারীর গানকে পাখির গানের মতোন শব্দ-বাক্যহীন করে ফেলতে পারে।
৭.
‘It is fatal to be a man or woman pure and simple: one must be a woman manly, or a man womanly.’ ঢাকাই চলচ্চিত্রের গান হোক বৈচিত্রময়। এর সুরে, কথায় সকল মানুষই সমানভাবে উঠে আসুক। পুরুষের মতোন নারীর ঘুম-স্বপ্নও যেন গুরুত্ব পায়। নারীর মতোন পুরুষের রূপের বর্ণনায়ও যেন উঠে আসে স্নিগ্ধ জোছনা, ফুলের ঘ্রাণ। পুরুষের মতোন নারীও যেন কোন কোন গানে ভ্রমরের সাথে তুলনা পায়। কোন গান শুনে যেন না মনে হয় নারীর দেহ, মন পুরুষের থেকে ভিন্ন, দুর্বোধ্য বা বিকৃত ।
আধুনিক হোক। বাংলা চলচ্চিত্রের গানে মুক্তির কথা, সাম্যের কথা, সত্যাকারের কবিতার মতোন উপযুক্ত কথা যেন শুনতে পাই। কাহিনীর প্রয়োজনে গান হতে পারে কখনও কখনও খানিকটা পুরুষতন্ত্রের তানে, কিন্তু অন্য কিছু গানও যেন এর বিরুদ্ধে কথা বলে।
যদি প্রতিবাদ না থাকে, একঘেয়ে, একতরফাভাবে গানগুলো গোঁড়া ঐতিহ্য আর অন্ধ পুরুষের আজন্মের সংস্কারকে বার বার, বহুবার ঘোষণা করে যায়, নারী সারাজীবন গানের খাঁচায় পাখি হয়ে ডানা ঝাপটাবে, অভিমানে মরে যাবে তার অধিকারের যত ফুল। পুরুষ গীতিকারের মনে খানিকটা নারীর মন বাসা বাঁধুক। অনেক নারী গীতিকবির জন্ম হোক খানিকটা পুরুষের আত্মবিশ্বাস নিয়ে। গানে যেন পাঞ্জাবি আর শাড়ির কথা আসে সমান তালে, মুখজোড়া দাড়ি যেন চোখে পড়ে ঘন চুলের মতোই। পুরুষের চোখ আর নারীর চোখের শক্তির যেমন কোন পার্থক্য নাই, গান যেমন দু’জনেই সমান কানে শোনে।